বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১২:৩৮ অপরাহ্ন

‘আলো আমার আলো’ গান বাজিয়ে রাজশাহীতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি আর আসবে না

প্রথম পাতা
প্রকাশিতঃ বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১২:৩৮ অপরাহ্ন

‘আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা। আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা॥’ রাজশাহীর অলিগলিতে এই গানটি বেজে উঠলেই পাঠকেরা ছুটে আসেন, তাঁদের পাঠাগার এসেছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিতে এই গান বাজত। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে এই গান শুনিয়ে গাড়িটি আর শহরের মোড়ে ঘুরবে না। পাঠকেরাও আর গাড়ির কাছে ছুটে আসবেন না।

দুই দিন আগে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এই কর্মসূচি স্থগিত করেছে। এখন ঢাকায় ফিরে যাওয়ার আগে চলছে বইয়ের হিসাব-নিকাশ। অবশ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রকল্প আবার চালু হলে আবার ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি চলবে। তবে পাঠকেরা এই অনিশ্চিত বিরতি মানতে পারছেন না। তাঁরা বলছেন, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই উদ্যোগ নেওয়ার দরকার ছিল। তাঁরা চান, যাতে এক দিনও গাড়ি না বন্ধ হয়।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি প্রকল্পটি সরকারি অনুদানে চলে। সরকার এই প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মচারীদের বেতন এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বহন করে। আর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তাদের গাড়ি এবং বই দিয়ে এই প্রকল্প সঙ্গে যুক্ত থাকে। প্রথমে দুই বছর মেয়াদি প্রকল্প ছিল। এরপর দুই বছরের জন্য আবার মেয়াদ বাড়ানো হয়। দ্বিতীয়বার আবার মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ নিয়ে প্রকল্পের বয়স এখন ছয় বছর। এবার আর মেয়াদ বাড়ানো সম্ভব হয়নি। হয়তো আগামী দিনে নতুন নামে প্রকল্প চালু হবে—এটাই আশা করছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কর্মকর্তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহী শহরে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির ১৯ হাজার ১৩৯ জন কার্ডধারী সদস্য রয়েছেন। তার মধ্যে নিয়মিত সদস্য এখন ২ হাজার ২০০ জন। শনিবার এক দিন সাপ্তাহিক ছুটি ব্যতীত প্রতিদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এই গাড়িটি আট ঘণ্টা ধরে শহরের ৪৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে বই বিলি করে আসছিল। পাঠাগারে বর্তমানে বইয়ের সংখ্যা ১৯ হাজার।

পাঠকের মাসিক সদস্য ফি মাত্র ১০ টাকা। ফেরতযোগ্য সাধারণ সদস্যদের জামানত ১০০ টাকা। এই পাঠক সর্বোচ্চ ২০০ টাকা মূল্যের বই বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন। বিশেষ সদস্যের জামানত ২০০ টাকা। তাঁরা সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা মূল্যের বই বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন। অগ্রবর্তী সদস্যের জামানত ৫০০ টাকা। তাঁরা ৭০০ টাকা মূল্যের পর্যন্ত বই বাড়িতে নিয়ে পড়তে পারেন। বিশেষ অগ্রবর্তী সদস্যের জামানত ৮০০ টাকা। তিনি যেকোনো মূল্যের বই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পড়তে পারেন। সদস্যপদ বাতিল হলে জামানত ফেরত দেওয়া হয়।

আজ শুক্রবার দুপুরে রাজশাহী নগরের তেরখাদিয়া স্টেডিয়ামের সামনে লাল রঙের গাড়িটি দেখা যায়। তবে কোনো গান নেই। এমনিই গাড়িটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সাধারণত যেখানেই গাড়িটি থামে, গান বাজতে থাকে। গান বন্ধ কেন, জানার জন্য ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, ইনচার্জসহ তিনজন লোক হিসাব-নিকাশ করছেন। তাঁরা বললেন, প্রকল্প আপাতত স্থগিত। তাঁরা এখন হিসাব মেলাচ্ছেন। গাড়ি ঢাকায় চলে যাবে।

এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানার জন্য কয়েকজন পাঠককে ফোন করা হলে তাঁরা এই প্রকল্প স্থগিতের বিষয় নিয়ে তাঁদের উদ্বেগের কথা জানালেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন সায়েন্স বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র মধুসূদন বর্মণ বললেন, ‘আমাদের স্মার্টফোনের কারণে ধৈর্য ধরে বইয়ের হার্ড কপি পড়ার প্রবণতা অনেক কমে গেছে। তার মধ্যেই আমরা যাঁরা এখনো হার্ড কপি পড়তে পছন্দ করি, তাঁদের সবার টাকা দিয়ে সব বই কিনে পড়ার সামর্থ্য নেই। আমি মনে করি, এই পাঠাগার চলমান রেখেই প্রকল্প নবায়ন করা উচিত। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক প্রকল্প একবার স্থগিত হলে আর চালু হয় না। এ ক্ষেত্রে আমাদের মতো পাঠকেরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, হতাশাগ্রস্ত হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী রেজাউল কবীর বললেন, ‘আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের আলোকিত মানুষ গড়ার এই পাঠাগার কখনোই থেমে যাবে, এটা আমরা চাই না।’ তিনি সায়ীদ স্যারের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে বললেন, ‘একটা মরুভূমির ভেতর দিয়ে আমরা হেঁটে যাচ্ছি। তারপরে গিয়ে একটি গাছের ছায়ায় বসলাম। এই বসার আগের অনুভূতি এবং পরের অনুভূতি আলাদা। গাছের ছায়ায় বসে আমরা শান্তি পেলাম। তো এই আলোকিত মানুষ গড়ার এই ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার পেয়ে আমরা আসলে শান্তি পেয়েছিলাম। আবু সায়ীদ স্যার নিজেই বলেন যে আমরা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যারা বই পড়তে আসি, তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত থাকতে পারে, কিন্তু আমরা সবাই প্রত্যেকের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকি।’ পাঠক রেজাউল বলেন, ‘এই জায়গা থেকে আমি বলব, ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার স্থগিত করা উচিত হবে না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জান্নাতুল তাজরী সোহাগী বলেন, ‘বই গণনার জন্য আপাতত কিছুদিনের জন্য ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার আসবে না। এটাই শুনেছি। প্রকল্প শেষ হয়ে গেছে এটা তো জানি না। আমি মনে করি, এই প্রকল্প কখনোই স্থগিত করা উচিত নয়। যদি মেয়াদ শেষ হয়, দ্রুত চালু করা উচিত। আমি বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। অনেক বই হাতের কাছে পাই না, যেটা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে পড়তে পারি।’

নগরের শিরোইল এলাকার পাঠক সাদিয়া আফরিন ও সুফিয়া শারমীন দুই বোন। তাঁরা দুজনই ২০১৮ সালে থেকে এই লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠক। কথা হয় সাদিয়ার সঙ্গে। তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। সুফিয়া এখন দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। সাদিয়া বলেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে তাঁদের বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। এরপর পাঠ্যবইয়ের প্রতিও মনোযোগ বেড়েছে। এই প্রকল্প স্থগিত হয়েছে এটা তাঁরা জানেন না। তাঁরা চান দ্রুত এই প্রকল্প চালু করা হোক। তিনি বলেন, এবার যেন দরকারি বই বেশি থাকে। একজন একটা বই ইস্যু করে নিলে ওই বই পেতে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।

মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক শামীম আল মামুন বলেন, প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণেই ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি আপাতত স্থগিত রাখা হচ্ছে। একটা প্রকল্প টানা ছয় বছর ধরে চলছে। নিয়ম অনুযায়ী এটা হয় না। প্রকল্পটি আবার চালু করার জন্য সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তবে এর নাম নতুন হতে পারে। অথবা আগের নামেই চলতে পারে। এ জন্য তাঁরা কর্মচারীদের চার মাসের বেতন অগ্রিম দিয়েছেন। বকেয়া শোধ করেছেন। প্রকল্প চালু হলে কেউ চাকরি হারাবেন না, যদি না তিনি কোনো নিয়মভঙ্গ করে থাকেন। এখন গাড়িগুলো ঢাকায় নিয়ে এসে মেরামত করা হবে।

পিআলো/জা/০১


আরো পড়ুন

মন্তব্য