শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৬:০০ অপরাহ্ন

সাবেক মেয়র লিটনের হস্তক্ষেপেই হাতছাড়া হয় রাবির ‘বড়কুঠি’!

প্রথম পাতা
প্রকাশিতঃ শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৬:০০ অপরাহ্ন

রাজশাহী অঞ্চলের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি স্থাপনা—বড়কুঠি। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমমার্ধে নির্মিত এই ভবনটি এক সময় ছিল ডাচদের ব্যবসাকেন্দ্র। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবার পর পাকিস্তান সরকার বড়কুঠি এবং এই স্থাপনা সংলগ্ন সম্পত্তি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে অর্পণ করেন।

দেশের অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহৎ বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত এই স্থাপনাটি এখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মালিকানাধীন। কিন্তু কিভাবে এই স্থাপনার মালিকানা পরিবর্তন হয়ে গেছে—সে বিষয়ে জানেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী।

বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে বাংলাভিশন নিশ্চিত হয়েছে, একসময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন বড়কুঠির উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব দিক সংলগ্ন কিছু ফাঁকা জায়গা নজরে পড়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের। যেগুলো মূলত ছিল জমিদারদের সম্পত্তি। বড়কুঠির স্থাপনা সরকারের মালিকানায় এনে আশপাশের জমি দখল এবং সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট আকারে বিক্রি করাই ছিল লিটনের মূল উদ্দেশ্য।

বাংলাভিশনের এই প্রতিবেদক খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে, ২০০৯-২০১৩ মেয়াদে মেয়র থাকাকালীন বড়কুঠিকে রাজশাহীর সিটি মিউজিয়াম গড়ার লক্ষ্যে তৎকালীন রাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুস সোবহানকে রাসিকের অর্থায়নে একটি সংস্কার প্রস্তাব দেন লিটন। কিন্তু সেই প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। রাসিক মেয়রের প্রস্তাবটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে উঠলে, সকল সদস্য এ প্রস্তাবটিকে নাকচ করেন।

তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সহযোগিতা নিয়ে, সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা লিটনের হস্তক্ষেপেই বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নিয়ে আসা হয় এই বড়কুঠি।

রাজশাহীর বড়কুঠির এ মালিকানা পরিবর্তনের বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের সাথে কথা বলেছেন এ প্রতিবেদক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে জড়িত একটি স্থাপনা হাতছাড়া হওয়ায়, তৎকালীন সরকার ও প্রশাসনের সমালোচনা করেছেন তারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. আমজাদ হোসেনকে বড়খুটির প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, “আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ছিলাম তখন বড়কুঠিকে সিটি মিউজিয়াম করতে সাবেক রাসিক মেয়র ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু তখন রাবি শিক্ষকদের সহযোগিতায় রাসিক মেয়রের জবরদখল ঠেকানো সম্ভব হয়। তারপর হঠাৎ একদিন শুনি এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মালিকানায় চলে গেছে।”

অধ্যাপক ড. আমজাদ হোসেন আরো বলেন, “বড়কুঠি দিয়েই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। যতদিন এ বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে, ততদিন বড়কুঠি নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গর্ব করবে। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে, বড়কুঠিকে আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।”

বড়কুঠি হাতছাড়া হওয়ায় বিগত প্রশাসনের সমালোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মশিহুর রহমান বলেন, “রাবির প্রাক্তন উপাচার্য আব্দুস সোবহান ব্যক্তিগত স্বার্থকে হাসিল করতে অর্থাৎ তার মেয়ে ও তার জামাতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়ার জন্য রাবির আওতাধীন বড়কুঠিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিকট হস্তান্তর করেন। এছাড়াও বড়কুঠির আশপাশের জমি অধিগ্রহণ করার জন্য সাবেক রাসিক মেয়র মূলত বড়কুঠিকে সিটি মিউজিয়াম করতে উদ্যোগ নেন। কিন্তু সেখানে সফল না হওয়ায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাবির কাছ থেকে বড়কুঠি ছিনিয়ে নেন।”

এদিকে সরকার পরিবর্তনের পর থেকে নিজেদের জন্মস্থান বড়কুঠি ফিরে পেতে অন্তবর্তী সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বড়কুঠিকে নিজেদের মালিকানাধীন ফিরে পেতে প্রয়োজনে আন্দোলনেও নামবেন বলে জানিয়েছেন তারা।

লোক প্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আল-মামুন বলেন, “বড়কুঠি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য বহন করে। বড়কুঠি ছাড়া রাবি শিক্ষার্থীরা এক ধরণের এতিম; কারণ আমাদের কোন জন্মস্থান নেই। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মিউজিয়াম করতে পারলে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কি পারতো না এটিকে মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহার করতে? সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ— রাবির সম্পদ রাবিকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। নাহলে আমরা আন্দোলনে বসতেও পিছপা হবো না।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীব জানিয়েছেন, ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ইতিহাস রয়েছে—সেটির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হচ্ছে এ বড়কুঠি। আমিও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে থাকাটাই সবথেকে শ্রেয়। বড়কুঠি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ল্যান্ডমার্ক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে অভিপ্রায়, আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করবো। বড়কুঠিকে রাবির অধীনে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রশাসন থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।


আরো পড়ুন

মন্তব্য