বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৭:৫৯ অপরাহ্ন

জুলাই বিপ্লবে গুলিতে নিহত মিনারুল, কাউন্সিলর দেন দুর্ঘটনার মৃত্যু সনদ

প্রথম পাতা
প্রকাশিতঃ বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৭:৫৯ অপরাহ্ন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নারায়ণগঞ্জে গুলিতে প্রাণ হারান পোশাক শ্রমিক মিনারুল ইসলাম (২৭)। পরদিন রাজশাহী নগরীর গুড়িপাড়া-পুরাপাড়া মহল্লার বাড়িতে লাশ নেওয়া হয়।  ছুটে আসেন সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রজব আলী।

তিনি পরিবারকে বলেন, মিনারুল গুলিতে নিহত হয়েছেন তা বলা যাবে না। সড়ক দুর্ঘটনার কথা বলে লাশ দাফন করতে হবে।

তৎকালীন প্রভাবশালী এই আওয়ামী লীগ নেতার মুখের ওপর তখন কোনো কথা বলতে পারেননি নিহত মিনারুলের ভাই নাজমুল হক। সড়ক দুর্ঘটনা বলেই মৃত্যু সনদ দেন তৎকালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজব আলী।

রাজশাহীতে এভাবেই জুলাই বিপ্লবের এক শহিদের মৃত্যু সনদে লেখা হয় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু। তবে নিহত মিনারুল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের দৃষ্টি এড়ায়নি। একজন শহিদ হিসেবেই তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তাকে।

সম্প্রতি তার পরিবার জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছে।

মিনারুল বিবাহিত ছিলেন। মিনারুলের যখন মৃত্যু হয় তখন তার স্ত্রী শম্পা খাতুন ছিলেন গর্ভবতী। স্বামী হারানোর পর পুত্রসন্তানের মা হয়েছেন শম্পা। স্বামীর সঙ্গে মিলিয়ে ছেলের নাম রেখেছেন মিনহাজুল ইসলাম। শিশুটির বয়স এখন ৩ মাস। জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন মিনারুলের স্ত্রী শম্পাকে চার লাখ ও মা ডলি বেগমকে এক লাখ টাকা দিয়েছে।

মিনারুল হকের ভাই মো. সোহেল জানান, ৫ আগস্টের আগে আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা কম দেখাতে কাউন্সিলর রজব আলী ও তার ভাই রাজশাহী মহানগর যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নাহিদ আক্তার নাহান তাদের বলতেই দেননি যে মিনারুল মারা গেছে পুলিশের গুলিতে। নানামুখী চাপে রেখেছিলেন তারা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পালিয়ে যান নাহান। আর ৭ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালাতে গিয়ে বিজিবির হাতে গ্রেফতার হন কাউন্সিলর রজব আলী।

এরপর গত ৩ সেপ্টেম্বর আরেক ভাই নাজমুল হক বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক এমপি শামীম ওসমান, নজরুল ইসলাম বাবু, গোলাম দস্তগীর গাজী, আব্দুল্লাহ আল কায়সার, নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীসহ ১৩০ জনকে আসামি করা হয়।

রাজশাহীর কাউন্সিলর রজব আলী, তার ভাই নাহিদ আক্তার নাহান ও স্থানীয় যুবলীগ নেতা জাকির হোসেনসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের স্থানীয় যেসব নেতাকর্মী পরিবারটিকে চাপে রেখেছিলেন- তাদেরও আসামি করা হয় এ মামলায়। রাজশাহীর আসামিরা মিনারুল ইসলামের মৃত্যুকে সড়ক দুর্ঘটনা বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ পরিবারের।

 

মিনারুলের যেভাবে মৃত্যু হয়

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে- গত ২০ জুলাই সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী রোডের আল আমিননগর এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো হয়। এ সময় মিনারুলের পেটের নিচে গুলি লাগে। আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে শহরের খানপুরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

গত ২২ জুলাই একটি পত্রিকার প্রথম পাতায় ‘নারায়ণগঞ্জে দু’দিনে নিহত ১৩’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়। এতে আন্দোলনে নিহত হিসেবে মিনারুলের নাম আসে। ১২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি রাজধানীর হাতিরপুলে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ‘পোশাক খাতের চলমান পরিস্থিতি ও করণীয় এবং গণঅভ্যুত্থানে নিহত পোশাক শ্রমিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ’ শিরোনামে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে নারায়ণগঞ্জের ১৪ জনের নাম প্রকাশ করা হয়, এদের একজন মিনারুল।

নারায়ণগঞ্জের কাগজ ২৬ সেপ্টেম্বর এক প্রতিবেদনে জানায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সারা দেশে নিহতের তালিকায় নারায়ণগঞ্জের তথ্য যুক্ত করা হচ্ছে। ওই সময় পর্যন্ত নিহতের তালিকায় নারায়ণগঞ্জের ২৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকার ৩৫ নম্বরে লেখা আছে- ‘মিনারুল ইসলাম, পিতা- মৃত এনামুল। গুডীপাড়ি, রাজশাহী।’

এছাড়া ১০ অক্টোবর একটি পত্রিকার অনলাইনে ‘নারায়ণগঞ্জে অভ্যুত্থানের দিনলিপি/যেভাবে ছড়িয়ে গেল দ্রোহের আগুন’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদে নিহতদের তালিকা প্রকাশ হয়। এর ৩৪ নম্বরে মিনারুলের নাম ও ঠিকানা প্রকাশ হয়।

 

নিকটাত্মীয় ও এলাকাবাসী যা বলেন

বৃহস্পতিবার সকালে রাজশাহী নগরীর গুড়িপাড়া পুরাপাড়া মহল্লায় বাড়িতে গিয়ে মিনারুলের মা ডলি বেগম ও তার রিকশাচালক দুই ভাই নাজমুল হক এবং মো. সোহেলের সঙ্গে কথা হয়। আন্দোলনে নিহত তার ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বলে প্রচার হলে তারা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। একজন শহিদকে নিয়ে এমন অপপ্রচারে ভীষণ কষ্টও পাচ্ছেন।

মিনারুলের মা ডলি বেগম জানান, প্রায় এক যুগ ধরে মিনারুল নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানায় কর্মরত ছিলেন। ২০ জুলাই মিনারুলসহ তিনজন বাজার করার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। তারপর আন্দোলনের মাঝে পড়ে মিনারুলের গুলি লাগে তলপেটে। তার সঙ্গে থাকা সহকর্মীরা ফোন করে বিষয়টি জানান। কিন্তু লাশ আনার পর তৎকালীন কাউন্সিলর রজব আলী এ কথা বলতে দেননি। তারা সড়ক দুর্ঘটনা বলে প্রচার করেন। শুধু তাই নয়, কাউন্সিলর রজব তার কার্যালয় থেকে মৃত্যু সনদও দেন সড়ক দুর্ঘটনা বলে।

ভাই সোহেল একটি ভিডিও দেখান। এই ভিডিওতে দেখা যায়, ট্রলির ওপর মিনারুলের নিথর দেহ পড়ে আছে। তার তলপেটের স্থান থেকে ব্যান্ডেজ খোলা হচ্ছে। সেখানে প্রায় আধা ইঞ্চি একটি গভীর ক্ষত। এটি বুলেটেরই ক্ষত বলে দাবি পরিবারের। এলাকাবাসীও বলছেন একই কথা।

মিনারুলের লাশ গোসল করিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা রেজাউল ইসলাম। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা হলে তো শরীরের অন্যান্য স্থানেও আঘাতের চিহ্ন দেখা যাবে; কিন্তু কোথাও কোনো আঘাত আমি দেখিনি। গোসলের সময় লাশ আমি উল্টে-পাল্টেই দেখেছি। শুধু তলপেটেই একটা গভীর ক্ষত ছিল। সেটা বুলেট ঢুকে যাওয়ার ক্ষত বলেই আমি মনে করি।

স্থানীয় বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন বলেন, লাশ আনার পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সময় পর্যন্ত রজব, তার ভাই নাহান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পরিবারটিকে চাপে রেখেছিল। তারা বলতেই দেয়নি যে মিনারুল আন্দোলনে নিহত। যারা পরিবারটিকে এমন চাপে রেখেছিল ওই মামলায় তাদেরও আসামি করা হয়েছে।

 

সুষ্ঠু তদন্ত দাবি

মিনারুলের মৃত্যুর পর নারায়ণগঞ্জে তার লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়নি। ময়নাতদন্ত ছাড়াই তড়িঘড়ি করে কাউন্সিলর রজব আলী লাশ স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ পরিবারের। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য দ্রুত লাশের ময়নাতদন্ত করার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। তারা বলছেন, ময়নাতদন্ত করলেই মৃত্যুর সঠিক কারণ সামনে আসবে।

আর একজন শহিদের মৃত্যুকে সড়ক দুর্ঘটনা বলে প্রচার করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক জিকেএম মেশকাত চৌধুরী মিশু। তিনি বলেন, আমরা জুলাই ফাউন্ডেশন ক্রস চেক করে টাকা দিয়েছি। অনেকে এখনো টাকা পায়নি তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া সম্ভব হয়নি বলে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত কেউ টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই মিনারুল ইসলামের পরিবারের পাশে দাঁড়াব। কারণ যে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে, তাদের এজেন্ট এখনো রয়ে গেছে। তারা আমাদের বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। যারা এসব অপপ্রচার করছে, তারা নিশ্চয়ই কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে।

রজব আলী গ্রেফতার থাকায় তিনি কাউন্সিলর থাকা অবস্থায় মিনারুলের মৃত্যুকে সড়ক দুর্ঘটনা দেখানোর অভিযোগ নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলা যায়নি। আত্মগোপনে থাকা তার ভাই নাহিদ আক্তার নাহানের মোবাইল ফোন বন্ধ। হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের সচিব সামশুল কবির বলেন, তিনি দুই মাস হলো এখানে এসেছেন। তিনি আসার আগে কিভাবে মৃত্যু সনদে সড়ক দুর্ঘটনা লেখা হয়েছে তা তিনি বলতে পারবেন না।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, আমরা মামলাটা তদন্ত করছি। সময় লাগলে লাগুক, তদন্ত সঠিক হবে। যেটা সঠিক, সেটাই বেরিয়ে আসবে।

 

যআন্তর/জা/০২


আরো পড়ুন

মন্তব্য