রাজশাহী সিল্ক ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর বিদেশিদের কাছে চাহিদা বেড়েছে। অনেক বিদেশি পর্যটক এখন রাজশাহী সিল্কের শোরুমগুলোতে এসে ওড়না, থ্রিপিস এবং শাড়ি কিনছেন। রাজশাহী সিল্ক জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় ২০২২ সালে। তবে সার্বিকভাবে রেশম শিল্পের অবস্থা ভালো নয়। অনেক বেসরকারি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
মিষ্টি পান ও আম জিআই স্বীকৃতি পেলেও বিদেশে নতুন করে চাহিদা বাড়েনি। অনেক আগে থেকেই পান বিদেশে রপ্তানি হয়ে আসছে। আর ২০১৪ সাল থেকে সরকারের উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের মাধ্যমে আম রপ্তানি হচ্ছে। কৃষি বিভাগ বলছে, মিষ্টি পান ও আম আপাতত জিআই পণ্য হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। ভবিষ্যতে সুফল আসবে।
রাজশাহীর বিসিক শিল্পনগরীতে সপুরা সিল্কের ৫০ হাজার বর্গফুটের শোরুম। এখানে সারাদেশ থেকে তো বটেই, বিদেশি পর্যটকরাও আসেন। সপুরা সিল্কের ব্যবস্থাপক সাইদুর রহমান বলেন, জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর এখন বিদেশিরাও তাদের শোরুমে আসেন। সিল্কের বিভিন্ন পোশাক কিনে নিয়ে যান। তবে জিআই স্বীকৃতির পরও তারা দাম বাড়াননি। সারাদেশের ক্রেতাদের দরেই বিদেশিরাও সিল্কের পোশাক কিনতে পারেন। গত সোমবার সপুরা সিল্কে পাবনার রূপপুরে কর্মরত রাশিয়ান কয়েকজন নারীকে দেখা গেল সিল্কের পোশাক কিনতে। তাদের একজন বলেন, ‘সিল্কের ওড়না আমার জন্য, আমার মা এবং মেয়ের জন্য কিনলাম। এটা বেশ ভালো।’
কোনো দেশের পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতি যদি একটি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে এবং ভৌগোলিক ও ঐতিহ্যগতভাবে যা ‘নিজস্ব’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, তাহলে ওই পণ্যকে দেশের ‘ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। জিআই স্বীকৃতি পেলে বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। দেশে-বিদেশে এসব পণ্যের একটি আলাদা কদর থাকে। শুধু তাই নয়, সনদপ্রাপ্তির পর ওই অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি একাধারে উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়। রাজশাহী অঞ্চলের জিআই পণ্যের মধ্যে রয়েছে– রাজশাহী সিল্ক, রাজশাহীর মিষ্টি পান, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম।
বন্ধ বেশির ভাগ রেশম কারখানা
রাজশাহীর বেসরকারি ৭৬টি কারখানার মধ্যে এখন ৫৮টি বন্ধ। কোনোমতে চালু আছে মাত্র ১৮টি। এগুলোর প্রধান ভরসা চীন থেকে আমদানি করা সুতার ওপর। রাজশাহীর একমাত্র সরকারি রেশম কারখানার ৪২টি লুমের মধ্যে ৬টি এখন চালু আছে। পর্যায়ক্রমে চালু থাকে ১৯টি। সুতা সংকট ও শ্রমিকের অভাবে কারখানাগুলো চালু করা যাচ্ছে না।
রাজশাহী রেশম শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি লিয়াকত আলী বলেন, রেশম চাষ খুবই লাভজনক। কিন্তু কিছু ভুল নীতির কারণে অনেকেই এ পেশা ছেড়েছেন। নামমাত্র কয়েকটি কারখানা টিকে আছে। এগুলো চলে চীন থেকে চড়া দামে কিনে আনা সুতায়। তিনি আরও বলেন, রেশম চাষ এখনও লাভজনক করা সম্ভব। এ জন্য আলু কিংবা মাছ চাষের মতো স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। বেসরকারি উদ্যোগ ছাড়া রেশম শিল্প লাভজনক করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (অর্থ ও পরিকল্পনা) ড. এম এ মান্নান বলেন, রেশম শিল্পের উন্নয়নে তাদের শতকোটি টাকার তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। ১৫ কোটি টাকার আরও একটি প্রকল্প পাইপলাইনে আছে। এটি চালু হলে রেশম চাষের আরও উন্নয়ন হবে। সুতার উৎপাদন বাড়বে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি কাজে লাগাতে সরকারের কৃষি বিভাগের সচেষ্ট হওয়া দরকার।
আম এবং মিষ্টি পান
জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আগে থেকেই রাজশাহীর বিখ্যাত মিষ্টি পান এবং আম বিদেশে রপ্তানি হতো। পান মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। ২০১৪ সাল থেকে ক্ষীরশাপাতি, ফজলি, ল্যাংড়া, আম্রপালিসহ বিভিন্ন প্রজাতির আম রপ্তানি হচ্ছে।
অনেকেই ভাবতে পারেন, রাজশাহীর প্রধান অর্থকরি ফসল আম। কিন্তু ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষির আয় হয় মাত্র ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকা। আর মাত্র সাড়ে চার হাজার হেক্টর জমিতে পান চাষ করে আয় হয় ২ থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা। পানের একটি বড় আয় আসে বিদেশ থেকে। যদিও জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর নতুন করে পানের চাহিদা বাড়েনি বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে এ বছর। এর সুফল ভবিষ্যেত মিলবে।
রাজশাহী অঞ্চলের পান চাষিরা বলছেন, পানের মতো অর্থকরি ফসল রাজশাহী অঞ্চলে আর দ্বিতীয়টি নেই। মাত্র ১০ কাঠা জমিতে পান চাষ করে বছরে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা আয় করেন চাষিরা। রাজশাহীর বাগমারার একজন উদ্যোক্তা অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ বলেন, পানের মতো আয় আর কোনো ফসল থেকে আসে না। মাত্র ১০ কাঠা জমিতে পান চাষ করলে ৫ সদস্যের একটি পরিবারের সংসার সারাবছর ভালোভাবে চলে যাবে। বছর শেষে কিছু সঞ্চয়ও হবে। তিনি বলেন, পান চাষ থেকে চাষিরা প্রচুর আয় করলেও এ বিষয়ে তারা কৃষি বিভাগের খুব বেশি সহযোগিতা পান না। তাই মাঝে মাঝে ভাইরাস আক্রান্ত হওয়াসহ মড়ক দেখা দেয়। এতে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। চাষিদের পান চাষে আরও উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। কারণ এ ফসল থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আসে। দেশের চাহিদাও পূরণ করে।
রাজশাহীর আমের দিকে চেয়ে থাকেন সারাদেশের মানুষ। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম জিআই স্বীকৃতি পায় গত বছর। রাজশাহীর প্রায় ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ করে চাষিরা আয় করেন ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকা। ফজলি আমের জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ যৌথভাবে। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জ আলাদাভাবে পেয়েছে ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাতি ও আশ্বিনা আমের জিআই স্বীকৃতি। নওগাঁ জেলায়ও আম চাষের বিস্তৃতি বেড়েছে। এই তিন জেলায় এখন প্রতিবছর আম থেকে চাষিরা পান অন্তত ৫ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আম চাষি শফিকুল ইসলাম ছানা বলেন, স্বীকৃতির আগে থেকেই রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ থেকে প্রতিবছরই কিছু আম বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। জিআই স্বীকৃতি মেলায় ভবিষ্যতে বিদেশে চাহিদা বাড়বে। এ জন্য উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনা মেনে আম উৎপাদন করা হচ্ছে। তিনি জানান, বিদেশে রপ্তানি ছাড়াও নতুন নতুন বিভিন্ন জাতের আম চাষিরা চাষ করে বেশি মুনাফা পাচ্ছেন। তবে অনেকেই আবার পুরোনো আম গাছ থেকে বেশি লাভ না পেয়ে পুকুর খনন করছেন। এটি না করে বারোমাসি বিভিন্ন জাতসহ আগাম ও বিলম্ব জাতের বিভিন্ন আম চাষ করে অধিক আয় করা সম্ভব।
রাজশাহীর আম চাষি সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমকে কেন্দ্র করে বছরের ৬ মাসেরও বেশি সময় রাজশাহী অঞ্চলে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়। মুকুল আসার আগে থেকে শুরু করে আম বাজারজাত পর্যন্ত এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান হয় আমে। এ ছাড়া সারাদেশের চাহিদা মিটিয়ে রাজশাহী অঞ্চলের আম এখন বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা হচ্ছে। নওগাঁর সাপাহারের আম চাষি সোহেল রানা বলেন, ‘প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আম রপ্তানি করছি। নওগাঁ জেলায় যেসব আম চাষ হচ্ছে, তা বিলম্ব জাতের বেশি। বারি-০৪, গৌড়মতি, আম্রপালি বেশি চাষ হচ্ছে। মৌসুম শেষে এই আম থাকায় দেশেও বেশি দাম পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর টাকা আয় হচ্ছে।’
কৃষি বিভাগ বলছে, আম ও পান মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। বিদেশে ব্যাপক হারে রপ্তানির জন্য বেসরকারি খাত এগিয়ে এলে চাষিরা আরও লাভবান হবে। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে সালমা বলেন, কৃষি বিভাগ এসব পণ্যের চাষ ও বাজারজাতে সব ধরনের সহযোগিতা করছে। জিআই পণ্যের স্বীকৃতি মেলায় দেশ-বিদেশে চাহিদা আরও বাড়বে। এতে রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে। জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির পর এখনও পান ও আম থেকে বিশেষ সুবিধা আসেনি। তবে ভবিষ্যতে আসবে। আপাতত পরিচিত হচ্ছে। রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু বলেন, জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এসব পণ্য ঐতিহ্যগত এবং অর্থনৈতিকভাবে রাজশাহীকে সমৃদ্ধ করেছে।
সূত্র: ইন্টারনেট