শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:০১ অপরাহ্ন

রাজশাহী হোমিওপ্যাথি কলেজের জমির প্রকৃত মালিক কে?

প্রথম পাতা
প্রকাশিতঃ শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:০১ অপরাহ্ন

রাজশাহী হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপিত হয় ১৯৬৬ সালে। এখানও এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলছে। সরকার পূর্ণাঙ্গ ভবন তৈরির পরিকল্পনা করলেও গত কয়েক বছর থেকে তা আটকিয়ে আছে। স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীদের বাধায় নির্মাণ কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। কলেজ কর্তৃপক্ষ ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা দ্রুতই সবকিছুর নিরসন চাচ্ছেন।

সাংস্কৃতিক কর্মীদের দাবি, হোমিওপ্যাথি কলেজ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈতৃক ভিটা। জায়গাটির উত্তরে গড়ে তোলা হয় হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের আধুনিক ভবন। এ ভবনের দক্ষিণ অংশে ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিবিজড়িত পুরনো বাড়ির ঘরগুলো অক্ষত ছিল। কিন্তু তা ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর ভেঙে ফেলা হয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি, ৫ আগস্টের কিছু শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা এসে বাড়িটি ভেঙে ফেলে। যদিও তা নিয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল।

সাংস্কৃতিক কর্মীদের ভাষ্য, ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক ভিটায় থেকে আবার ঋত্বিক ঘটককে ‘ভূমিদস্যু’ বানানোর অপচেষ্টা রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক কলেজ চালিয়ে যাচ্ছে। জমিটি দ্রুত অবমুক্ত করে ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈতৃক ভিটার আবহকে কেন্দ্র করে ‘ঋত্বিক কমপ্লেক্স’ ভবন নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তারা। যেখানে থাকবে ‘ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র কেন্দ্র’, ‘ঋত্বিক ফিল্ম ইন্সটিটিউট’, ঋত্বিক সংগ্রহশালা বা সাংস্কৃতিক জাদুঘর, স্টুডিও, সেমিনার হল, সিনেপ্লেক্স, এক্সিবিশন গ্যালারি, বিভিন্ন ধরনের ল্যাব ও গ্রন্থাগার। তবে এসবের কোনো পরিকল্পনা নেই কলেজ কর্তৃপক্ষের। তারা শুধু অডিটোরিয়ামে ঋত্বিক ঘটকের নাম বসাতে চেয়েছে।

এই জমিটি ১৯৮৫ সাল থেকে রাজশাহী হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নামে দেওয়া হয়েছে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ এই জমিটি দেন কলেজ কর্তৃপক্ষকে। রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের স্মারক নং- ৩(৮)গোপ/৮৫-৯৬২ তারিখ ২ নভেম্বর ১৯৮৫ নির্দেশনায় ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রণালয়ের ওই বছরের ১৮ নভেম্বর ৫-১৫১/৮৫/১১৪০/১ স্মারক মূলে হোমিওপ্যাথি কলেজকে স্থায়ীভাবে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে জমি মৌজা-রামপুর-১০, খতিয়ান নং-১২৭, দাগ নং ১৭৮। হোমিওপ্যাথি কলেজের নামে নামজারি করা আছে। ১৯৮৫ সালের পর থেকে নিয়মিত খাজনা ও হোল্ডিং ট্যাক্সও দিয়ে আসছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।

১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার ঋষিকেশ দাশ লেনের বাসায় জন্মগ্রহণ করেন ঋত্বিক কুমার ঘটক। পাবনার বেড়া উপজেলার ভারেঙ্গা গ্রামে ঋত্বিক ঘটকের মূল বাড়ি। তার বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হলেও কবিতা ও নাটক লিখতেন। মা ইন্দুবালা দেবী। বাবা-মায়ের এগারোতম এবং কনিষ্ঠ সন্তান তিনি। তার স্কুলজীবন শুরু হয় ময়মনসিংহে, এরপর রাজশাহী কলেজ থেকে তিনি আইএ পাস করেন। ১৯৪৮ সালে বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এমএ কোর্সে ভর্তি হন। তবে তা তিনি শেষ করেননি। তবে দেশ ভাগ হওয়ার আগে তার পুরো পরিবার ভারতে চল যান। কলকাতায় গিয়ে তিনি স্থায়ী হন।

হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ঋত্বিক কুমার ঘটকের মা বিট্রিশ আমলে এক মুসলমানের কাছ থেকে ওই জায়গাটি কিনেছিলেন। মূলত এই বাড়িটি ছিল ঋত্বিক ঘটকের নানার বাড়ি। তার বাবা বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করেছেন। তার শিশুকাল কেটেছে ময়মনসিংহে। ঋত্বিক ঘটক নবম-দশম শ্রেণিতে থাকতে তার বাবা অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তারা রাজশাহীতে চলে আসেন। রাজশাহী কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে পড়াশোনা করলেও তিনি কলকতার একটি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। আইএ পাস করার পর তিনি স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে যান। এরপর তিনি আর জীবনে রাজশাহীতে আসেননি। রাজশাহীর জন্য ঋত্বিক ঘটকের অবদান নীল। উনার বাবা-মাও চলে যান কলকতায়। উনারাও কলকাতায় গিয়ে স্থায়ী হন।

তিনি আরও বলেন, ঋত্বিক ঘটকের মায়ের ভাই পঁচা কবিরাজ তাদের এই বাড়িটি দেখাশোনা করতো। ইতিহাসে আমরা পঁচা কবিরাজ হিসেবেই পেয়েছি। কবিরাজিতে তিনি খুব সেরা ছিলেন সেই আমলে। ১৯৬৫ সালে তাদের এই বাড়ি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত করে পাকিস্তান সরকার। ১৯৬৬ সালে এই জমিটি রেকর্ড হয়েছে হোমিও কলেজের নামে। তারপর এখানে হোমিও কলেজ হলো। ১৯৬৬ সালের খতিয়ানে লেখা আছে ইন্দুবালা দেবী ভারতবাসী। ১৯৮৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ স্থায়ীভাবে হোমিও কলেজকে দিয়ে দেন।

এই গবেষক আরও বলেন, এই শতাব্দীর শুরু থেকেও ঋত্বিক কুমার ঘটকের নাম ছিল না। দেশ স্বাধীনের পরেও ঋত্বিক কুমার ঘটক বাংলাদেশে এসেছিলেন তিতাস একটি নদীর নাম সিনেমার শুটিং করতে। সেসময় তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়েছিলেন, কুমিল্লায় গিয়েছিলেন কিন্তু  রাজশাহীতে আসেননি।  রাজশাহীর প্রতি তার কোনো মর্মবেদনা নেই, সামান্যতম ফিলিংসও নেই।

রাজশাহীর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মুস্তাফিজুর রহমান খান আলমও বললেন একই কথা। তিনি বলেন, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ১০০ টাকার বিনিময়ে হোমিওপ্যাথি কলেজকে দিয়েছেন। পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা পাস করিয়েছেন। তবে তার অর্ধেক কাজ হয়েছে। এখনও পুরো কাজ হয়নি। পুরো ভবন না নির্মাণ হলে মেডিকেল কলেজ স্বয়ংসম্পন্ন হবে না। কলেজ কর্তৃপক্ষও ঋত্বিক কুমার ঘটকের স্মৃতি সংরক্ষণ করবে বলে জানিয়েছে। তারা অডিটোরিয়ামের নাম নির্ধারণ করেছে। নিচতলায় ম্যুরাল নির্মাণ করবে। এর বাইরেও তাদের বেশকিছু পরিকল্পনা আছে। এটা অন্য কারও জমি না। এই জমির মালিক এখন রাজশাহী হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অর্পিত সম্পত্তি হয়ে গেছে।

রাজশাহী হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের খণ্ড-কালীন শিক্ষক ছিলেন ডা. আ ফ ম জাহিদ। তিনি ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন। এরপর এই প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে যান। এরপর ২০০৯ সাল থেকে তিনি ঋত্বিক ঘটকের নাম করে কলেজের জমি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
তবে জমি দখলের চেষ্টার অভিযোগ নাকচ করেছেন ডা. আ ফ ম জাহিদ। তিনি বলেন, আমাকে ওই কলেজে খণ্ড-কালীন চিকিৎসক নিয়োগ দেন তৎকালীন অধ্যক্ষ ইয়াসিন আলী। আমি মাসে আটটি করে অ্যানাটমির ক্লাস নিতাম। এর বিনিময়ে আমাকে মাসে ৪০০ টাকা ভাতা দেওয়া হতো। ব্যস্ততার কারণে আমি ২০০৮ সালে অব্যাহতি নিয়ে নিই। রাজশাহীতে চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতির ধারা এগিয়ে নিতে ঋত্বিক কুমার ঘটক নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি। এরপর থেকে প্রতিবছর ঋত্বিক কুমার ঘটককে স্মরণ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, আমি এই সংগঠনের সাথে নেই প্রায় আট মাস হলো। নানা ব্যস্ততার কারণে আমি অব্যাহতি নিয়েছি। তারা যে জমি দখলের কথা বলছে, তা সম্পন্ন বানোয়াট কথা। আমরা চাই, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ঋত্বিক কুমার ঘটককে স্মরণে রাখতে। এই জমির মালিক ঋত্বিক কুমারের মা ইন্দুবালা দেবী। আমরা এনিয়ে অনেক আলোচনা করেছি। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ এই জমি ছাড় দিতে চাচ্ছে না। তারা ঋত্বিক কুমারের কোনো অস্তিত্ব রাখবে না।
তবে এই কলেজকে রক্ষার দাবিতে স্মারকলিপিসহ আন্দোলন করে আসছেন কলেজের শিক্ষক, সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। এর সাথে যোগ হয়েছেন স্থানীয় হোমিও চিকিৎসকরা। কলেজকে রক্ষার দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছে ডিএইচএমএস ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন। ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন ও বর্তমান-প্রাক্তন শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, হোমিও পেশাজীবীর স্মারকলিপিতেও ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটিকে ‘ভূইফোঁড়’ বলা হয়েছে। এই ভূইফোঁড় শব্দটি মানতে নারাজ সংগঠনটি।
ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হোসেন মাসুদ বলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ এখন আমাদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছে। আমরা প্রতিবছর ঋত্বিক ঘটক সম্মাননা দিয়ে থাকি। যেখানে ভারত, নেপাল, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র অনুরাগীরা সম্মাননা গ্রহণ করেন। এমন সংগঠনকে কেন তারা ভূইফোঁড় বলছে তা বোধগম্য নয়। আমরা কলেজের বিপক্ষে না। কলেজ তার জায়গাতে আছে।
তিনি বলেন, কলেজের দক্ষিণে যে যায়গাটুকু আছে তা ঋত্বিক ঘটকের মায়ের নামে। কলেজ যেখানে আছে সেখানে থাকুক। আমরা কলেজ দখল বা এর কোন ক্ষতি চাচ্ছি না। এই কলেজটাও ঐতিহ্যবাহী কলেজ। যে ফাঁকা জায়গাটি আছে আমরা সেটুকু চাচ্ছি। সেখানে সরকারি বা ব্যক্তি উদ্যোগে ঋত্বিক ঘটকের ফিল্ম ইন্সটিটিউট বা এরকম করার চিন্তা আছে আমাদের। এখানে সংস্কৃতির চর্চা হবে। কলেজ তার জায়গাতে থাকবে। কলেজের যদি জায়গা প্রয়োজন হয় তাহলে সেখানেই বহুতল ভবন তৈরি করুক।
রাজশাহী হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. আনিসুর রহমান বলেন, আমি এই কলেজে ২০১৫ সাল থেকে অধ্যক্ষ হিসেবে আছি। আমাদের এই প্রতিষ্ঠান বড় হচ্ছে। এখানে চিকিৎসা সেবাও দেওয়া হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী আছে। আমাদের এই ভবনে এতো শিক্ষিার্থীর জায়গা হচ্ছে না। বর্হিবিভাগও করা হয়েছে একটি শ্রেণিকক্ষ নিয়ে। যে সংগঠনগুলো দাবি করছে, ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি তা সত্য নয়। হোমিওপ্যাথি কলেজের নামে তা ১৯৮৫ সালে দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে খাজনা ও হোল্ডিং ট্যাক্স দিয়ে আসা হচ্ছে।
তিনি বলেন, কলেজের দক্ষিণ পাশের নকশা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। আমরা কাজ শুরু করবো কিন্তু তা করতে পারছি না। কয়েকটি সংগঠন বাধা দিচ্ছে। নতুন ভবনে বহির্বিভাগ, প্যাথলজি, শ্রেণিকক্ষ ও চারতলায় মিলনায়তন ভবন করা হবে।  রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও নতুন ভবন তৈরির অনুমতি দিয়েছে। তবুও একটি সংগঠনের বাধায়  শিক্ষা ও উন্নয়ন কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) ও রাজশাহী হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সভাপতি টুকটুক তালুকদার বলেন, এনিয়ে তদন্ত চলছে। এর আগেও তৎকালিন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তদন্ত করেছিলেন। তা ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তদন্তে ভূমি মন্ত্রণালয় প্রশ্ন জানতে চেয়েছিলেন তাও পাঠানো হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়।


আরো পড়ুন

মন্তব্য