মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫, ০৩:৩০ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনামঃ
খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে দোয়া ও ইফতার মাহফিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা রিপোর্টার্স ক্লাবের উদ্যোগে অসহায়দের মাঝে ইফতার বিতরণ গভীর রাতে পুড়ে ছাই আড়াইশ হাঁশ-মুরগিসহ দোকান চাঁপাইনবাবগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে দোয়া ও ইফতার মাহফিল প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ তানোরে কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত চাঁপাইনবাবগঞ্জে জিয়া সাইবার ফোর্সের ১০ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালিত চাঁপাইনবাবগঞ্জে ইকো টয়লেট পরিদর্শনে জাপানের নিষ্কাশন ও পরিবেশ এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারপার্সন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত এখন টিভির সাংবাদিক মাসুমা আক্তারের মৃত্যু কার্যালয় নির্মাণে ২৫ লাখ টাকা দেয়ার ঘোষণা আশরাফ চেয়ারম্যানের

রাজশাহী নগরের উন্নয়নে জনঅধিকার সুরক্ষা হচ্ছে কি?

সম্পাদকীয়
প্রকাশিতঃ মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫, ০৩:৩০ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ও গঙ্গা (পদ্মা) নদী বিধৌত সবুজ শহর রাজশাহীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য বাংলাদেশের মধ্যে অনন্য। অনুকূল ও নিরাপদ পরিবেশের কারণে এখানে নগর সৃষ্টি হয়েছে। দিনে দিনে নানা শ্রেণী পেশার মানুষের বসবাসে সমৃদ্ধ হয়েছে এই নগর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে, শহরের জীবিকার সন্ধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে ভূমিহীন, দুর্যোগপীড়িত, দরিদ্র এবং বেকার লোকের শহরাঞ্চলে আগমনের প্রবণতা ছিলো। বস্তিতে বসবাস করা ছাড়া তাদের কাছে অন্যকোনো উপায় ছিলো না। শহরে আসা লোকদের মধ্যে কেউ কেউ খাস ও খালি জমিতে, মহাসড়ক বা রেললাইনের ধারে ছোট ছোট হালকা ঘর নির্মাণ করে বসবাস করে। সময়ের ব্যবধানে বস্তিবাসীদের সমস্যার হার বাড়তে থাকে। এই শহরে দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও নগর দরিদ্র বস্তিবাসীদের জন্য কার্যকর কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। অথচ এই মানুষগুলোই নগরের মানুষদের নানা সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

শহরের উন্নয়নের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও নগরের বস্তিবাসী, প্রান্তিক দরিদ্র মানুষের উন্নয়নে কার্যকর কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। প্রতিটি নির্বাচনে বস্তিবাসীদের জন্য রাজনৈতিক নেতারা বস্তিবাসীর আবাসন সংকট সমাধানে নির্বাচনি ইশতেহার দিলেও নির্বাচিত হবার পর তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। প্রতিবছর উন্নয়ন বাজেটে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন থেকে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়ার কথা থাকলেও তা কখনো বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় এবং ভোটের সময় নগরের মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে  গার্মেন্টস ও নিটওয়্যার কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন, গার্মেন্টসসহ অন্যান্য ট্রেডে দক্ষ শ্রমিক গড়ে তোলার জন্য ট্রেনিং ইন্সটিটিউট নির্মাণ, আইটি ভিলেজ  স্থাপন করে কম্পিউটার একসেসের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা, দরিদ্র ও ভূমিহীনদের জন্য আবাসন প্রকল্প গ্রহণসহ নানা উদ্যোগ নেবার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প শুধু রাস্তাঘাট আর ইট পাথরের কাজে লাগনো হয়েছে। রাজশাহী হাইটেক পার্ক গড়ে উঠলেও সেখানে শহর দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান একেবারেই নেই বলা চলে।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের মূলমন্ত্রই হলো সবাইকে সাথে করে নিয়ে উন্নয়ন, কাউকে পিছে ফেলে নয়। আগামীর উন্নয়নে তাই এই দিকটি গুরুত্ব দেবার কথা। কিন্তু বিগত সময়ে আমরা যে বৈষম্যমূলক উন্নয়নধারা দেখেছি তা সত্যিই হতাশাজনক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো নিয়মিনীতির তোয়াক্কা না করে, জনগণকে সম্পৃক্ত না করে ইচ্ছে খুশি মতো সকল মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তা জনগণের প্রয়োজনে আসুক বা না আসুক। প্রকল্পকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় জনগণের উপকারে কতোটা আসলো তা কখনো মূল্যায়ন করা হয়নি। অন্যদিকে অনেক প্রকল্পের কোনো ধরনের কার্যকর পরিবেশ সমীক্ষা না করে নামকা ওয়াস্তে সেগুলো প্রতিবেদন তৈরি করে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার কারণে সবুজ শহর, পরিবেশবান্ধব শহর আজ পুকুর-দিঘি, বড় বড় বৃক্ষ শুণ্য হতে চলেছে। রাস্তাঘাটে অতিরিক্ত লাইটিং ব্যবহারের কারণে লাইট পলিউশন (আলোর দূষণ) দেখা দিয়েছে। যার ফলে সেগুলো পরিবেশ বিপর্যয় বা স্থানীয় প্রাণ প্রকৃতির ক্ষতিও ডেকে আনছে। একই সাথে শহরের প্রান্তিক মানুষের পানির অধিকারসহ মৌলিক অধিকারগুলোতে প্রবেশাধিকার আরো কঠিন হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয়ভাবে নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুরক্ষার কথা বলা আছে। জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত বা বিনষ্ট করে এমন কোনো প্রকল্প, কাজ বা আইন নীতিমালাও তৈরি করতে নিষেধ করা আছে সংবিধানসহ বিভিন্ন পরিবেশ আইনে। কিন্তু আমরা যখন একটি পুকুর ভরাট করে শহরের প্রান্তিক মানুষের পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত করি সেটি কি আইনের পরিপন্থি হয়ে যায় না? এরকম নানা কাজ বা প্রকল্প আমরা হরহামেশাই করে থাকি। রাষ্ট্রের পদে থেকে বা রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান যদি এমন কোনো উদ্যোগ নেয় তাহলে তা খুবই ভয়ংকর। পরিবেশ ধ্বংস এবং মানুষের অধিকার ও প্রাণ প্রকৃতির সমস্যা যেখানে এমন কোনো কাজ করার অধিকার কারোরই থাকার কথা না। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যহার করে আমরা এসব করে থাকি। ক্ষমতার মসনদে বসে যখন ক্ষমতাবানরাই এসব অপরাধ করেন তখন জনগোষ্ঠীর করার কিছু থাকে না। এরকম ‘হোয়াইট-কলার অপরাধ’ বন্ধ না হলে আমাদের অধিকারও দিনে দিনে সংকোচিত হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বস্তিশুমারী ২০১৪  অনুযায়ী, রাজশাহী নগরে ১০৪টি বস্তি আছে, যার জনসংখ্যা সেই সময়ে দেখানো হয়েছে ৩৯ হাজার ৭৭ জন। ১০ বছর পেরিয়ে হয়তো তা আরো বেড়েছে। বস্তিশুমারী অনুযায়ী ৮০.৫৫% পরিবার সরকারি জমিতে ঝুঁপড়ি বা ছোট টিনের ঘরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করেন। যেখানে বিদ্যুৎ, পানির সুবিধা নেই। সংবিধান অনুযায়ী ১৮টি মৌলিক অধিকারের মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য, বাসস্থান, পোশাক, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার অধিকারগুলোও পরিপূর্ণ নেই এই শহর বস্তির মানুষগুলোর। হাজার হাজার কোটির টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত শহর প্রান্তিক বস্তিবাসীর জন্য কোনো ধরনের আবাসনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে ঝুপড়ি ঘরে মানবেতর জীবনযাপন, ঘরে বিদ্যুৎ নেই, খাবার পানির উৎস নেই। নিয়ম নীতির কথা বলে রাজশাহী ওয়াসা, নেসকো এই বস্তিবাসীর জন্য সেবাগুলো থেকে বঞ্চিত করেছে। রাজশাহীর বস্তিবাসীদের এখন প্রধান সমস্যা আবাসন বা বাসস্থান, পানির ও বিদ্যুতের সমস্যা। এরপর আরো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা তাদের উপযোগী কর্মসংস্থান এবং নিরাপত্তা জনিত সমস্যা।

রাজশাহী নগর দরিদ্র মানুষের অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির আহাবায়ক মো. খোরসেদ আলম রাজশাহী নগরের উন্নয়ন নিয়ে কথা বলেছেন। তার মতে, হাজার কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও আমাদের দরিদ্র প্রান্তিক মানুষের দারিদ্র্যতা নিরসনে সিটি কর্পোরেশন কোনো কার্যকর প্রকল্প বা পদক্ষেপ নেয়নি। শুধু আশ্বাস দিয়ে এসেছে, কোনো কাজ করেনি। তাদের আবাসন নেই, থাকার জায়গা নেই, বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, ছেলে-মেয়েদের কোনো কর্মসংস্থান নেই। এগুলো সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেবার দাবি করেন তিনি।

এই শহরে গাছ কেটে যখন আমরা হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শিশুপার্ক, উদ্যান তৈরি করি, যেখানে টিকিট কেটে উচ্চবিত্তদের সুযোগ করে দিচ্ছি বিনোদনের। সেখানে শহরের গরীব প্রান্তিক মানুষের আবাসন সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া শুধু আন্তরিকতার দরকার। বর্তমান শাসকদেরকেই এই পদক্ষেপ নিতে হবে দ্রুত। নাগরিক বা জনঅধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে নগরের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো গহণ করা এখন সময়ের দাবি। বৈষম্যমুক্ত একটি সমাজ বির্নিমাণে আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যেও পরিবর্তন আনতে হবে।

লেখক:

পরিবেশ আইন গবেষক

বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজ (বারসিক)

shahidul546mh@gmail.com

 

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর ডেস্ক


আরো পড়ুন

মন্তব্য