২০১০ সালের ১ আগস্ট রাজশাহী পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ-ওয়াসা আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে নগরীতে। আগে মহানগরীতে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার দায়িত্বে ছিল রাজশাহী সিটি করপোরেশন।
Advertisement
সিটি করপোরেশন থেকে পাওয়া পানি উৎপাদক গভীর নলকূপ, একটি পানি শোধনাগার ও পাইপ লাইন নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে নবগঠিত রাজশাহী ওয়াসা। নগরীর ঘরে ঘরে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করে ওয়াসা। ওয়াসার পানি সরবরাহ পাইপ লাইনের দৈর্ঘ প্রায় ৭৭১ কিলোমিটার।
পানি চুরি ও অপচয় রাজশাহী ওয়াসার একটি অন্যতম বড় সমস্যা হয়ে রয়েছে বর্তমানে। এই চুরি ও অপচয়ের পরিমাণ উত্তোলিত পানির প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ। বিপুল পরিমাণ পানি চুরি ও অপচয়ের কারণে রাজশাহী ওয়াসা বছরে প্রায় ৮ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে।
রাজশাহী ওয়াসা কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী, তারা নগরীর ৭০ ভাগ এলাকায় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পেরেছে। বাকি ৩০ ভাগ এলাকার মানুষ হস্তচালিত নলকূপের মাধ্যমে পানির চাহিদা পূরণ করে এলাকাবাসী। কর্তৃপক্ষের আরও দাবি রাজশাহী ওয়াসা প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন।
প্রকল্পের আওতায় আগামিতে পদ্মার পানি তুলে পরিশোধন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে শতভাগ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করবে ওয়াসা। চীনা ঋণের প্রকল্পটি বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন। বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আর পানির সুযোগ থাকবে না। পানির সংকটও আর ভোগ করতে হবে না নগরবাসীকে।
সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে রাজশাহী ওয়াসা কর্তৃপক্ষের যখন কার্যক্রম শুরু করে তখন নগরীর জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাত লাখ। পানি উত্তোলন ও সরবরাহ পরিকল্পনা সেই আগের জনসংখ্যার হিসাবকে কেন্দ্র করে এখনো চলছে। এদিকে অব্যাহত নগরায়নের ফলে ১৪ বছর পর বর্তমানে রাজশাহী নগরীর জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ লাখ। ফলে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় প্রায়ই পানি সংকটের অভিযোগ আসে কর্তৃপক্ষের কাছে।
ওয়াসার পানির বিশুদ্ধতা নিয়েও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। রাজশাহী ওয়াসার কার্যক্রম শুরুর সময় ভূ-গর্ভ থেকে পানি উত্তোলক গভীর নলকূপের ছিল ৫৬ টি। বর্তমানে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলক গভীর নলকূপের বেড়ে হয়েছে ১১০টি। তবে কিছু নতুন পাইপ লাইন নির্মাণ হলেও পুরনো আমলের লাইনে নগরীর অধিকাংশ এলাকায় এখনো পানি সরবরাহ করছে ওয়াসা।
এর ফলে পানি চুরি ও অপচয়ের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বছর বছর যে বিপুল পরিমাণ লোকসান করছে ওয়াসা তারও কারণ পুরনো অবকাঠামো ও চুরি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় জনবল না থাকা।
জানা গেছে, রাজশাহী মহানগর এলাকায় ওয়াসার বর্তমান পানি গ্রাহকের সংখ্যা ৪৭ হাজার ১২৭ জন। রাজশাহী ওয়াসা দৈনিক ৮ কোটি ৬৫ লাখ লিটার ভূ-গর্ভস্থ পানি তোলে। এর মধ্যে ৯৬ লাখ লিটার পানি পরিশোধন করতে পারে সংস্থাটি। উত্তোলিত এই পানির সিংগভাগই পরিশোধন ছাড়াই পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে সরবরাহ করা হয়। ফলে সরবরাহকৃত পানিতে দূষিত জীবাণুর উপস্থিতি ধরা পড়ে বছরখানেক আগে।
রাজশাহী মহানগরীতে দৈনিক পানির চাহিদা প্রায় ১১ কোটি ৩২ লাখ লিটার। ফলে নগরীতে দৈনিক পানি ঘাটতির পরিমাণ রয়েছে ২ কোটি ৬৭ লাখ লিটার। নগরীর মানুষ বিপুল পরিমাণ ঘাটতি পানির চাহিদা মেটায় পুকুর জলাশয়, বাসা বাড়িতে নিজস্ব মালিকানায় স্থাপিত হস্তচালিত নলকূপ ও সাবমারসিবল পাম্পের মাধ্যমে।
জানা গেছে, রাজশাহীতে বর্তমানে বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম ১৩ টাকা ৬২ পয়সা। অন্যদিকে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি হাজার লিটার পানির দাম ৬ টাকা ৮১ পয়সা।
রাজশাহী ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী পারভেজ মাহমুদ জানান, প্রতি এক হাজার লিটার পানি উত্তোলনে আমাদের খরচ হয় ৮ টাকা ৯০ পয়সা। সেক্ষেত্রে আমরা উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কম দামে পানি সরবরাহ করি। পানির দাম না বাড়ালে ক্ষতির পরিমাণ বছর বছর বাড়বে বলে আশঙ্কা তার। কারণ পানি উত্তোলন, সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণখাতে পরিচালন ব্যয় ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী ওয়াসা বছরে শুধু পানি উত্তোলন খাতে ব্যয় করেন শত কোটি টাকার বেশি। কিন্তু পানি গ্রাহকদের কাছ থেকে বছরে রাজস্ব আসে মাত্র ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকা। যদিও পানি থেকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা থাকে ২৭ থেকে ৩০ কোটি টাকা।
সূত্রমতে, এ অঞ্চলে ওয়াসার পানি চুরি ও অপচয়ের কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে। বছরে এই ক্ষতির পরিমান ৮ থেকে সাড়ে আট কোটি টাকা বলে জানা গেছে। এই ক্ষতিকে ওয়াসা কারিগরী অপচয় বা সিস্টেম লস বলে আসছেন।
সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে রাজশাহী ওয়াসার পানির কারিগরি অপচয় বেড়েছে। এই সিস্টেম লসের কারণে দৈনিক আড়াই কোটি লিটার পানি অপচয় হচ্ছে। এই অপচয়ের মধ্যে পাইপ লাইন কেটে পানি চুরি ছাড়াও বিভিন্ন নির্মাণ সাইটে পাইপ লাইন থেকে পানি নেওয়া হচ্ছে অবৈধভাবে। এসব চুরি প্রতিরোধের জন্য তীব্র জনবল সংকটকেই দায়ী করেছেন কর্মকর্তারা।
রাজশাহী ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী পারভেজ মাহমুদ বলেন, রাজশাহী ওয়াসায় জনবল সংকট তীব্র। বর্তমানে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে এখানে আড়াই শতাধিক জনবল কাজ করছেন। কিন্তু বিপুল সংখ্যক জনবল নেই বিভিন্ন বিভাগে। পাইপ লাইন রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে পানির অপচয় রোধে অনেক জায়গাতে প্রয়োজনীয় লোকবল নেই। বিভিন্ন কারণে জনবল বাড়ানো যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, রাজশাহী ওয়াসা গোদাগাড়ীতে পদ্মার পানি তুলে পরিশোধন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে গোটা নগরীতে সরবরাহ করবে। আগামী ২০২৭ সালের জুনে বৃহৎ এই প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন হবে। তখন পানি নিয়ে কারো অভিযোগ থাকবে না।
রাজশাহী ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) জাকির হোসেন বলেন, পানির কারিগরি সিস্টেম লসের সাধারণ পরিসীমা ১০ শতাংশ গ্রহণযোগ্য; কিন্তু বিভিন্ন কারণে রাজশাহী ওয়াসার সিস্টেম লস কিছুটা বেশি। আমরা বিভিন্নভাবে কাম্য পরিসীমায় নামিয়ে আনার চেষ্টা করছি। মেগা প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলে কারিগরি সিস্টেম লস আর থাকবে না। এর ফলে রাজশাহী ওয়াসার রাজস্ব বাড়বে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হারে।