রাজশাহীর বিভিন্ন আদালতে সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) নিয়োগ নিয়ে বিভক্তি তৈরি হয়েছে স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ দুই ছাত্রের হত্যা মামলার আসামি পক্ষের আইনজীবীরাও এই বিশেষ পদে নিয়োগ পাওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করাও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী দিনে স্থানীয় রাজনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
গত ৩ নভেম্বর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আইন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো পত্রে জেলা জজ, জেলা জজ ও দায়রা, দ্রুত বিচার, বিভাগীয় বিশেষ জজ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ১ ও ২, সাইবার, জননিরাপত্তা বিঘœকারী অপরাধ দমন, সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, মানব পাচার অপরাধ দমন, শিশু আদালত ১ ও ২ এবং মহানগর দায়রা জজ আদালতে মোট ১২৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
১২৪ জন নতুন আইন কর্মকর্তাদের নিয়ে নানা প্রসঙ্গ এখন আলোচনায়। বড় জটিলতা তৈরি হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। অভিযোগ উঠেছে, প্রায় সব পদেই বিএনপিপন্থিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জামায়াত বা অন্য সংগঠন ও সাধারণ আইনজীবীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। মূল পিপি, স্পেশাল পিপি ও বিশেষ পিপি পদে মোট আট পদে জামায়াতের কোনো আইনজীবীকে জায়গা দেওয়া হয়নি। ২৫টি অতিরিক্ত পিপি পদে জামায়াতকে দেওয়া হয়েছে একটি। সাতটি অতিরিক্ত জিপির পদে একজন নিয়োগ পেয়েছেন জামায়াতের। দলটির কয়েকজনকে শুধু সহকারী পিপি হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে সাধারণ আইনজীবীদেরও বঞ্চিত করার অভিযোগ উঠেছে।
জামায়াতপন্থি আইনজীবী ও রাজশাহী বার অ্যাসোসিয়েশনের নেতা হাসানুল বান্না সোহাগ বলেন, এই পদগুলোর সংখ্যা প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়ানো বা কমানো যায়। এ তালিকা দেখে আমরা চরমভাবে অসন্তুষ্ট ও মর্মাহত।
আইনজীবীদের অভিযোগ, গত ৫ আগস্ট রাজশাহীতে শহীদ আলী রায়হান ও শহীদ আনজুম সাকিব হত্যা মামলার আসামিপক্ষের হয়ে মামলা পরিচালনা করা আইনজীবীরাও নিয়োগ পেয়েছেন এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে। এ ঘটনায় আইনজীবীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।
বিএনপিপন্থি আইনজীবী জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নবনিযুক্ত পিপি রাইসুল ইসলাম নিজেই ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের আসামিদের পক্ষে মামলা লড়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। শহীদ আলী রায়হান ও শহীদ সাকিব আনজুম হত্যা মামলার আসামিদের জামিনের জন্য তার স্বাক্ষরিত একটি ওকালতনামার কপিও ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে রাইসুল সিল দেওয়ার পর নাম ক্রস চিহ্ন দিয়ে কেটে দিয়েছেন। তিনি নিজেই হেয়ারিং করেছেন। তার জুনিয়র অ্যাডভোকেট শহিদ উদ্দিন চান্দাও সঙ্গে ছিলেন।
ওই আদালতের অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট আজিমুস সান উজ্জ্বলও জুলাই বিপ্লবে ছাত্রদের বিপক্ষে দাঁড়ানো আসামিদের হয়ে আদালতে মামলা লড়েছেন। তারও স্বাক্ষর করা ওকালতনামার কপি পাওয়া গেছে। এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এর নতুন পিপি অ্যাডভোকেট ইমতিয়ার মাসরুর আল আমীনও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হয়ে মামলা পরিচালনা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিএনপিপন্থি আইনজীবী পারভেজ তৌফিক জাহেদীর নামও রয়েছে ওই তালিকায়।
এ ব্যাপারে অ্যাডভোকেট রাইসুল ইসলাম ছাত্র আন্দোলনে হত্যা মামলার আসামিদের পক্ষে মামলা লড়ার প্রশ্নে বলেন, হত্যা মামলায় আমরা নিজেরাই বাদীর লোক। কাজেই এ তথ্য সঠিক নয়। কিছু কিছু জায়গায় বিএনপিরও কিছু লোক অজ্ঞাতের মধ্যে ঢুকে হয়রানির শিকার হচ্ছে। আমাদের লোক যদি কোথাও ঢুকে যায়, তাদের জন্য হয়তো আমাদের কিছু করা লাগবে। আমার ক্লোজ বন্ধুও আওয়ামী লীগ করার জন্য ধরা পড়ছে, তাদের জন্যও কিছু করছি না। পুলিশ একটা বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
জামায়াতের আইনজীবীদের নাখোশ হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা এক সঙ্গে বসে আছি। তালিকা থেকে বিএনপিরও কিছু বাদ গেছে, জামায়াতেরও কিছু বাদ গেছে। এটা কারেকশনের জন্য চেষ্টা করছি।
এ বিষয়ে নগর জামায়াতের নায়েবে আমির ও রাজশাহী বারের সাবেক সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আবু মোহাম্মদ সেলিম বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করে আমরা বৈষম্যের শিকার। আন্দোলন সংগ্রামে যারা মিছিল-মিটিং করেছে, তাদের নাম নেই। এ নিয়োগের প্রতিবাদ জানাই আমরা। বৈষম্যহীন ও স্বচ্ছভাবে নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
রাজশাহী নগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ঈশা বলেন, এগুলো আমি জানি না। আর এই নিয়োগের ব্যাপারে আমার সঙ্গে পরামর্শও করেনি। আমার সঙ্গে তারা কোনোরকম আলোচনা না করেই এটা করেছে। আর নিয়োগে কারা কীভাবে এসেছে, নিয়োগ কীভাবে হয়েছে, কতজন হয়েছেএগুলো কিছুই আমার নলেজে নেই।
জানতে চাইলে রাজশাহী নগর জামায়াতের সেক্রেটারি ইমাজ উদ্দীন ম-ল বলেন, এখানে দীর্ঘ সময় ধরে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধের আইনজীবীরা এক সঙ্গে পথ চলছে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হয়েছে। আমরা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতাদের বলেছি এটা কী করা যায়। তা না হলে আগামী দিনে দেখা যাবে, পারস্পরিক সহমর্মিতা ও এক সঙ্গে পথচলার ঐতিহ্য নষ্ট হবে।
ছাত্র হত্যা মামলার আসামিদের পক্ষে লড়া আইনজীবীদের নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা মোটেও ঠিক হয়নি। যারা এই খুনিদের সহযোগিতা করছে, আইনি হোক আর যেভাবেই হোক তাদের এ ধরনের পোস্টে আনার সুযোগ নেই। তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিত। কিন্তু এখানে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। আমরা এর প্রতিবাদ করছি ও তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও রাসিকের সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু বলেন, রাজশাহী বারের রাজনীতি বিএনপি ও জামায়াতের যৌথ আলোচনার মাধ্যমেই হয়ে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যাপারে আমরা সিনিয়র আইনজীবী মিজানুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে একটা খসড়া ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সেটি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। আমি এই নিয়োগে সন্তুষ্ট না।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মেশকাত মিশু বলেন, যে আকাক্সক্ষা নিয়ে ছাত্র-জনতা জুলাই বিপ্লব গড়ে তুলেছিল, সেই আকাক্সক্ষার প্রতিফলন এই নিয়োগে ঘটেনি। ছাত্র-জনতা একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজপথে নেমেছিল। কিন্তু এখনো যদি দলীয় বিবেচনায় সরকারি পদে নিয়োগ হয়, যোগ্য ও আন্দোলনে ভূমিকা রাখা ব্যক্তিরা বঞ্চিত হয়, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। শহীদ আলী রায়হান ভাই ও শহীদ সাকিব আঞ্জুম ভাইয়ের হত্যাকারীদের আইনি সহায়তা দেওয়া এবং তাদেরই গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে নিয়োগের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। ফ্যাসিস্টদের দোসরদের পুনর্বাসনকারীদের ছাত্রসমাজ মেনে নেবে না।
সূত্র: ইন্টারনেট