রাজশাহীতে বইতে শুরু করেছে নির্বাচনের হাওয়া। দিনক্ষণের ঘোষণা না এলেও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে মুখিয়ে আছে বিএনপি ও জামায়াত। রাজশাহীর ছয়টি সংসদীয় আসনে মাঠে তৎপর বিএনপির প্রায় তিন ডজন মনোনয়নপ্রত্যাশী। তারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন নেতাকর্মীদের সঙ্গে, নানা কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন।
এরই মধ্যে দুটি আসনের জন্য প্রার্থী চূড়ান্ত করে ফেলেছে জামায়াত, বাকিগুলোতে মনোনয়নে কাজ করছে দলটি। কেন্দ্রীয়ভাবে দলের অবস্থা যেমনই হোক না কেন, স্থানীয়ভাবে জাতীয় পার্টিরও কয়েকজন নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু করেছেন। তবে খোঁজ নেই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। একের পর এক মামলার চাপ আর গ্রেফতার আতঙ্কে লাপাত্তা তারা। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
রাজশাহীর যে দুটি আসনে জামায়াতের প্রার্থী নিশ্চিত করা হয়েছে সেগুলো হলো-রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) ও রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট)। প্রার্থীরা হলেন-১-এ জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সাবেক এমপি অধ্যাপক মজিবুর রহমান এবং ৬-এ জেলা জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি অধ্যাপক মো. নাজমুল হক। রাজশাহী মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি এমাজ উদ্দীন মন্ডল যুগান্তরকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে নির্বাচন করতেন অধ্যাপক মাজেদুর রহমান। তিনি মৃত্যুবরণ করায় এ আসনটি নিয়ে আমাদের নতুনভাবে ভাবতে হচ্ছে।
রাজশাহী-২, ৪ ও ৫ আসনে কারা প্রার্থী হবেন, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কেন্দ্রকে জানানো হয়েছে। কেন্দ্র থেকেই সিদ্ধান্ত আসবে। রাজশাহীর ছয়টি আসনের পাশাপাশি জামায়াত রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও অংশ নেবে।
রাজশাহী-১ আসনে নির্বাচনি কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন মেজর জেনারেল (অব.) শরীফ উদ্দীন। তিনি বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী প্রয়াত ব্যারিস্টার আমিনুল হকের ছোট ভাই। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সামরিক সচিব ছিলেন শরীফ। বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। এ আসনে আরও মাঠে রয়েছেন-জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি সাজেদুর রহমান খান মার্কনি, জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক হযরত আলী ও বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট সুলতানুল ইসলাম তারেক।
শরীফ উদ্দিনের অনুসারী কাঁকনহাট পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন, তিনি (শরীফ) ইতোমধ্যে বিএনপি এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছেন। তার প্রয়াত ভাই ব্যারিস্টার আমিনুল হক গোদাগাড়ী ও তানোরে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। এ বিষয়টি এ এলাকার মানুষের মনে আছে। এছাড়া তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে এলাকায় বিএনপিকে তৃণমূল পর্যায়ে শক্তিশালী করতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছেন। সামনের নির্বাচনে বিএনপির হাইকমান্ড শরীফ উদ্দিনকে মনোনয়ন দেবে বলে আমরা আশাবাদী।
রাজশাহী-২ (সদর) আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসাবে দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু নির্বাচনি প্রচার শুরু করেছেন। ১০ নভেম্বর মিনুর অনুসারীরা রাজশাহীতে ব্যাপক শোডাউন করেছেন। মিনু রাজশাহী সিটি করপোরেশনে টানা ১৭ বছর মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া তিনি একবার সদর আসনের এমপিও ছিলেন। এ আসনে বিএনপির অন্য কেউ এখনো তাদের মনোভাব প্রকাশ করেননি।
মিনু যুগান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়া রাজশাহীর উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। রাজশাহী অঞ্চল মূলত বিএনপির ঘাঁটি। ভোটাররা আমাকে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসাবে বারবার নির্বাচিত করেছেন। এছাড়া ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে আমি আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে লক্ষাধিক ভোটে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হয়েছি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং হাইকমান্ড এসব বিবেচনায় নিয়ে আমাকে আবারও এ আসন থেকে মনোনয়ন দেবে বলে আশাবাদী।
এদিকে রাজশাহী সদর আসনে নির্বাচনে অংশ নিতে চান জাতীয় পার্টির কেন্দ্রের ভাইস চেয়ারম্যান এবং রাজশাহী মহানগর আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম স্বপন। তিনি বলেন, আমি শুধু রাজশাহী-২ আসন না, রাজশাহী-১ এবং ৩ আসনেও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন কেন্দ্রের ত্রাণ ও পুনর্বাসন-বিষয়ক সম্পাদক এবং রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শফিকুল হক মিলন। তিনি ২০১৮ সালে এ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ আসনে এবার বিএনপির অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আরও রয়েছেন-জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রায়হানুল ইসলাম রায়হান, মোহনপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আব্দুস সামাদ এবং সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী প্রয়াত অ্যাডভোকেট কবির হোসেনের ছেলে নাসির হোসেন অস্থির।
মিলন যুগান্তরকে বলেন, পবা ও মোহনপুরে দলকে শক্তিশালী করতে আমি কয়েক বছর থেকে কাজ করছি। বিএনপি এ এলাকায় তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে। আশা করছি এবারও আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে।
রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন-উপজেলা বিএনপির আহবায়ক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ডিএম জিয়াউর রহমান, সদস্য-সচিব অধ্যাপক কামাল হোসেন, জেলা যুবদলের সদস্য সচিব রেজাউল করিম টুটুল এবং আমেরিকা প্রবাসী বিএনপি নেতা জাহিদ দেওয়ান শামীম। বাগমারা উপজেলা বিএনপির সদস্য-সচিব অধ্যাপক কামাল হোসেন বলেন, আমি বিএনপির দুর্দিনে নেতাকর্মীদের সঙ্গে কাজ করেছি। এখনও দলকে শক্তিশালী করতে নেতাকর্মীদের সঙ্গে রয়েছি। আশা করছি, এসব বিবেচনায় নিয়ে দলের হাইকমান্ড আমাকে মনোনয়ন দেবেন।
রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে বিএনপির প্রার্থী সবচেয়ে বেশি। পুঠিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মন্ডল মনোনয়নপ্রত্যাশী। এর আগে তিনি দুবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্যরা হলেন-এ আসনের সাবেক এমপি প্রয়াত নাদিম মোস্তফার ছেলে জুলকার নাঈম মোস্তফা বিস্ময়, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পুঠিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু বক্কর সিদ্দিক, ব্যবসায়ী ইসফা খায়রুল শিমুল, মহিলা দলের নেতা মাহমুদা হাবিবা, সাবেক ছাত্রদল নেতা গোলাম মোস্তফা, শ্রমিক দল নেতা রোকনুজ্জামান আলম, দুর্গাপুর উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি গোলাম সাকলায়েন ও বিএনপি নেতা সিরাজুল করিম সনু। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে এ আসনে জাতীয় পার্টি থেকে সাবেক এমপি অধ্যাপক আবুল হোসেনও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে পারেন।
রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনেও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ছড়াছড়ি। আলোচনায় সবচেয়ে বড় নাম আবু সাঈদ চাঁদ। তিনি জেলা বিএনপির আহ্বায়ক। আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে আট বছর অর্থাৎ অর্ধেক সময় কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। এসময়ে তার নামে মামলা হয়েছে ৮৫টি। বাঘা-চারঘাটে দলমত নির্বিশেষে তার রয়েছে ব্যাপক জনসমর্থন।
এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে এছাড়া রয়েছেন-জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি বজলুর রহমান, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন, জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল, বাঘা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নুরুজ্জামান খান মানিক, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দেবাশিষ রায় মধু এবং রমেশ দত্ত। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি থেকে জেলা আহ্বায়ক শামসুদ্দিন রিন্টু নির্বাচন করার বিষয়ে আশাবাদী।
বিএনপি নেতাদের প্রার্থীদের নির্বাচনি তৎপরতায় অংশ নেওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রের সাংগঠনিক সম্পাদক (রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত) সৈয়দ শাহীন শওকত যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির হাইকমান্ড এখনো মনোনয়ন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি। কারণ, আমরা এখন দল গোছাতে ব্যস্ত রয়েছি। আমরা জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে কাজ করছি। তবে বিগত ১৬ বছরে যারা দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছেন-মনোনয়নের ব্যাপারে তাদের প্রাধান্য দেওয়া হবে।
সূত্র: ইন্টারনেট