মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের উপপরিচালক (ডিডি) ড. শরমিন ফেরদৌস চৌধুরী এক অফিসেই দায়িত্বে রয়েছেন ১১ বছর। এমপিও দুর্নীতি, সনদ জালিয়াতি, বদলি বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে তাকে একবার ঢাকায় বদলি করা হলেও প্রভাব খাটিয়ে সাত মাসের মাথায় তিনি আবারও রাজশাহীতে ফিরেছেন। তার বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে শিক্ষকদের এমপিওভুক্তিসহ রয়েছে নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ। একই কর্মস্থলে তিন বছরের বেশি সময় পার করেছেন-এমন কর্মকর্তাদের তথ্য জানতে চেয়ে গত বছরের ১৫ মে মাউশির সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক-১) দুর্গা রানী সিকদার দেশের সব উপপরিচালককে চিঠি দেন। তালিকা পাওয়ার পর মন্ত্রণালয় বেশকিছু কর্মকর্তাকে বদলি করে। কিন্তু শরমিন ফেরদৌস চৌধুরী এখনো রাজশাহীতেই বহাল রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ড. শরমিন ফেরদৌস চৌধুরী রাজশাহীর প্রমথনাথ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ২০১২ সালের নভেম্বরে তাকে মাউশির রাজশাহী অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক হিসাবে পদায়ন করা হয়। ২০১৮ সালের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক গোপনীয় প্রতিবেদনে মাউশির ১৭৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নানা অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ড. শরমিনকে রাজশাহী থেকে ঢাকায় শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। এরপর প্রমথনাথ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তৌহিদ আরাকে মাউশির রাজশাহী অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত ডিডি করা হয়।
কিন্তু বদলির পরই রাজশাহী ফিরতে তদবির শুরু করেন ড. শরমিন। ফলে ২০১৯ সালের ২৪ ফেরুয়ারি তৌহিদ আরাকে আবার স্কুলে ফেরত পাঠানো হয়। আর সাত মাস পর আবার রাজশাহী অঞ্চলের ডিডি হয়ে ফিরে আসেন শরমিন ফেরদৌস। সেই থেকে তিনি এখনো বহাল আছেন। মাঝের সাত মাস বাদে তিনি প্রায় ১১ বছর ধরেই এ পদ আঁকড়ে আছেন।
ডিডি শরমিনের সঙ্গে তার অনিয়ম-দুর্নীতির সহযোগী হিসাবে পরিচিত প্রোগ্রামার মো. মামুন ও উচ্চমান সহকারী আবদুল আওয়ালকেও ঢাকায় বদলি করা হয়েছিল। সাত মাসের মাথায় ডিডি শরমিনের সঙ্গে তারাও রাজশাহী ফিরে আসেন। এর আগে ২০১৮ সালেও তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করেছিল মাউশি। রাজশাহী কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ হধিববুর রহমানের তদন্তে তিনি রহস্যজনক কারণে পার পেয়ে যান। হবিবুর রহমান বলেন, ‘ডিডি সরাসরি ঘুস নিয়ে কাজ করেন-এমন প্রমাণ পাইনি। তার নামে অফিসের অন্য কেউ ঘুস নিতে পারে, এটা সব অফিসেই হয়। তবে রিপোর্টে একটা কথা লিখেছিলাম, ডিডির আচরণগত সমস্যা আছে।’
ডিডি শরমিন ফেরদৌসের বিরুদ্ধে সম্প্রতি মাউশির সচিবের কাছে আবার লিখিত অভিযোগ করেছেন বাঘা উপজেলার এক ব্যক্তি। অভিযোগের সঙ্গে তিনি ড. শরমিনের অনিয়ম-দুর্নীতির ফিরিস্তিও তুলে ধরেছেন। এতে সচিবালয়ের পদস্থ কোনো কর্মকর্তাকে দিয়ে নিরপেক্ষভাবে অভিযোগগুলোর তদন্তের অনুরোধ করা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, শরমিন ফেরদৌস শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জন্য নিজের প্রতিনিধির মাধ্যমে ঘুস নেন। শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। তার স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে কোনো শিক্ষক কথা বললেই তাকে তিনি রাজশাহী বিভাগের বাইরে বদলি করে দেন। ডিডি শরমিন জনবল কাঠামো ও নীতিমালা-২০২১ লঙ্ঘন করে ২০২২ সালে রাজশাহীর বিবি হিন্দু একাডেমির সহকারী শিক্ষক মনিকা রানী পালকে এমপিওভুক্ত করেন। মনিকা এক বিষয়ে পাশ করলেও তাকে অন্য বিষয়ের শিক্ষক হিসাবে টাকার বিনিময়ে এমপিও দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, ১২ বছরের অভিজ্ঞতা না থাকলেও তিনি রাজশাহীর চারঘাটের নিমপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসাবে ইমদাদুল হকের এমপিও করে দেন। জাল সনদের মাধ্যমেই ডিডি শরমিন তার এমপিও করেন। পরে মাউশি মহাপরিচালকের কার্যালয় অনিয়ম ধরা পড়লে ইমদাদুল হকের বেতন বন্ধ করে দেয়। তবে ডিডি শরমিনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
একইভাবে জাল সনদের মাধ্যমে বাঘা উপজেলার চক রাজাপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জেসমিন আরা বেগমের এমপিও করে দিয়েছেন ডিডি শরমিন। পরে মহাপরিচালকের কার্যালয় জেসমিন বেগমেরও বেতন বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ডিডি আছেন বহাল তবিয়তে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, বাঘার কেশবপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান বিএড স্কেলের জন্য প্রথমে ঢাকার রয়েল ইউনিভার্সিটির জাল সনদ দিয়ে এমপিওর আবেদন করেন। ডিডি শরমিন ফেরদৌস প্রথমে তা বাতিল করে দেন। তবে ৫ মাসের মাথায় দালালের মাধ্যমে দুই লাখ টাকা নিয়ে ডিডি শরমিন তাকে বিএড স্কেল দেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, নওগাঁর আত্রাইয়ের খন জোর জয়সাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক নাজমা আক্তার বানু, রাজশাহীর পুঠিয়ার গোটিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক মোজাফফর হোসেন ও দুর্গাপুরের পানানগর দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রোকনুজ্জামানের কাম্য শিক্ষকতা যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ডিডি শরমিন তাদের এমপিও করে দিয়েছেন।
ডিডি শরমিন ফেরদৌস চৌধুরী এসব অভিযোগের ব্যাপারে বলেন, ‘সনদ যাচাইয়ের প্রথম কাজ স্কুল কমিটির। পরে উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হয়ে ৬৭টি উপজেলার কাগজপত্র আমার কাছে আসে। যেগুলো অনলাইনে যাচাই করার সুযোগ থাকে, সেগুলো আমরা করি। অনেক পুরোনো সনদ অনলাইনে যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না। সেটা আমরা করিও না। ফাইল আসার পর ১০ দিনের মধ্যে আমাকে অগ্রগামী করতে হয়। আমি এত যাচাই করতে গেলে ১০ দিনে ১০টা ফাইলের কাজও শেষ করতে পারব না।’
তিনি বলেন, ‘তিন ধাপ পেরিয়ে যখন কাগজ আমার কাছে আসে, তখন এটাকে সঠিক বলেই ধরে নেওয়া যায়। সনদ জাল হলে এর জন্য একমাত্র দায়ী প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক। আমার দায় নেই।’ অনিয়মের মাধ্যমে এমপিও করে দেওয়ার অভিযোগ তিনি পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন।
একই দপ্তরে শরমিন ফেরদৌসের ১১ বছর ধরে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরকারি মাধ্যমিক অধিশাখার যুগ্মসচিব কাজি মো. আবদুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।