মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:০৩ পূর্বাহ্ন

অপরাধে ৬ মাসেই পরিপক্ক ছাত্রলীগের নতুন কমিটি !

শেখ আল আসিফ
প্রকাশিতঃ মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:০৩ পূর্বাহ্ন
ছাত্রলীগের নতুন কমিটি

গত বছরের ২১ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণার পর পদবঞ্চিতদের সঙ্গে দেখা দেয় দ্বন্দ্ব। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এক নেতার মধ্যস্থতায় এর তিন দিন পর ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারে নতুন কমিটির নেতৃবৃন্দ। আর নতুন এই কমিটির দায়িত্বগ্রহণের ছয় মাস না যেতেই একের পর এক অভিযোগের মধ্যে পড়ছেন তারা। চাঁদাবাজি, মারধর, হলে সিট বাণিজ্য, রুম দখল, সাংবাদিকসহ অন্য দলের নেতাকর্মীদের পেটানো, ডাইনিং ও ক্যান্টিনে ফ্রি খাওয়ার মতো অভিযোগ সামনে এসেছে নতুন কমিটির একাধিক নেতৃবৃন্দ ও তাদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে। একই ধরনের অভিযোগ ছিল র পূর্বের কমিটির বিরুদ্ধে।

এদিকে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তির জন্য জবাবদিহির অভাব ও বিচারহীনতাকেই দায়ী করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও রাজনীতি পর্যবেক্ষকবৃন্দ। তাদের দাবি শুধু ছাত্রলীগই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী বা কর্মচারী যদি অপরাধ করে পার পেয়ে যায়, তবে তা হবে নেতিবাচক দৃষ্টান্ত। যা ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে সহযোগিতা করবে।

হলের আবাসিক শিক্ষার্থী, প্রত্যক্ষদর্শী, ভুক্তভোগী ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ১৩ নভেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আব্দুল লতিফ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী বিবেক সাহাকে কক্ষ থেকে বের করে দেওয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের

মধ্যে দেশীয় অস্ত্রসহ উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থানের ঘটনা ঘটে। এর পর ২১ নভেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হলের ১৪০ নম্বর কক্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী নিকল রায়কে তার বৈধ আসন থেকে নামিয়ে দেন শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মিনহাজ ইসলাম।

একই মাসে ২২ নভেম্বর শামসুজ্জোহা হলের ২১৪ নম্বর কক্ষে শাহাবুদ্দিন নামে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে মারধরের অভিযোগ ওঠে হল শাখা ছাত্রলীগের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে। এর আগে ৪ নভেম্বর মতিহার হলের ক্যান্টিনের একই সিটে জাহিদ হাসান ও শান্ত নামে দুই শিক্ষার্থীর আগে ও পরে দুপুরের খাবার খেতে বসাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগে দুই পক্ষের কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গত ২৫ নভেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হলে উচ্চস্বরে গান বাজাতে নিষেধ করায় এক শিক্ষার্থী ও এক সাংবাদিককে মারধর করেন ছাত্রলীগের কয়েক নেতাকর্মী। এ ঘটনায় গত ১০ ডিসেম্বর শহীদ হবিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি আলআমিন আকাশসহ ছাত্রলীগের পাঁচ নেতাকর্মীকে শাস্তির আওতায় আনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

গত ৪ জানুয়ারি শহীদ শামসুজ্জোহা হলে আট হাজার টাকায় সিট বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে একই হলের ছাত্রলীগকর্মী আল আমিন পিয়াসের বিরুদ্ধে। ৫ ফেব্রুয়ারি ছয় বাম ছাত্রসংগঠন জাবিতে ছাত্রলীগ কর্তৃক স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করে। এসময় বাম নেতাকর্মীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ান শাখা ছাত্রলীগ নেতারা। পরে ঘটনাস্থলে সাংবাদিকরা উপস্থিত হলে তারা সরে

যান। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি খাবারে তেলাপোকা ও মাছি ফেলে আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে গত ৫ বছর ধরে ডাইনিং ও ক্যান্টিনে টাকা না দিয়ে খাবার খাওয়ার য়ার অভিযোগ ওঠে হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা মিনহাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে।

এ ছাড়াও ২০ ফেব্রুয়ারি লতিফ হলের ২১২ নম্বর কক্ষ (দুই সিটের রুম) অবৈধভাবে দখল, হল প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, হল ত্যাগের নির্দেশ অমান্য করা, হলের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা ও ছাত্র হত্যাকাণ্ডের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং রাবি শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম হোসাইনের কক্ষ সিলগালা করে হল প্রশাসন।

এক মাস না যেতেই গত ৭ মার্চ বেগম রোকেয়া হলের ৩২৩ নম্বর কক্ষের দরজা বন্ধ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের রোজিনা আক্তার নামে এক শিক্ষার্থীকে মারধরের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের একাধিক নেত্রীর বিরুদ্ধে।

এদিকে চলতি বছরে ভর্তি পরীক্ষায় ক্যাম্পাসের ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ ওঠে শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদেকুল ইসলাম, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবিদ আল হাসান, নবাব আবদুল লতিফ হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি তাশফিক আল তৌহিদ

এবং মাদার বখশ হলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক

তামিম খানের বিরুদ্ধে। ১৩ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদ হাসান ওরফে সোহাগ এবং শহীদ হবিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও একই হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা মিনহাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসের একটি খাবারের দোকানে গিয়ে চাঁদাবাজি করার অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় দুই নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় দফায় দফায় হুমকির শিকার হন ভুক্তভোগী খাবারের দোকানি।

গত ১৮ এপ্রিল শহীদ হবিবুর রহমান হলের ১৪৬ নং কক্ষে গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী এবং আবাসিক ছাত্র ইমরান ইসলামের সিট দখল করে অনাবাসিক শিক্ষার্থীকে তুলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে শহীদ হবিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের কয়েক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় সিট দখলের পরদিন শুক্রবার ডেকে নিয়ে ওই শিক্ষার্থীকে হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী। হল বাণিজ্য নিয়ে গত ২ মে শাহ্ মখদুম হল ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।

সর্বশেষ, গত ৬ মে রাতে রাবি শাখা ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক নাফিউল ইসলাম জীবন ও তার বন্ধুকে তিন ঘণ্টা আটকে মারধর, মানসিক নির্যাতন ও পিস্তল ঠেকিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ ওঠে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে। এর আগে গত ২ নভেম্বর ক্যাম্পাসে অবস্থানকালে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের ৫ নেতাকর্মীকে মারধর করে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেন শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তবে সব অভিযোগই অস্বীকার করেছেন ছাত্রলীগ নেতারা।

রাবি স্টুডেন্টস রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মেহেদী সজীব বলেন, ‘বর্তমান সময়ে একটি নির্দিষ্ট ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে অগণিত অভিযোগ সামনে আসছে। এসব ঘটনার বিচার না হওয়ার কারণে অগোচরে থেকে যাচ্ছে ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ।’

একই কথা বলেন, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দীন খান। তার ভাষায়, ‘বিচারহীনতার

সংস্কৃতির ফলেই ধারাবাহিকভাবে তারা (ছাত্রলীগ) বিভিন্ন ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। এদের বিচারের আওতায় আনার নৈতিক দৃঢ়তা প্রশাসনের নেই। ফলে দিনের পর দিন তারা (ছাত্রলীগ) নানা ধরনের অনিয়ম করে যাচ্ছে। অনেক সময় তারা (শিক্ষার্থীরা) অভিযোগ আনলেও প্রশাসন সেগুলো আমলে নেয় না। সত্যিকার অর্থে তারা (প্রাধ্যক্ষ) নৈতিক অবস্থান থেকে, দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করছে না। হলগুলোতে মেধার ভিত্তিতে আসন দিতে পারছে না। সেখানে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। হল প্রশাসন শক্ত হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তায় সেগুলো দূর করা সম্ভব হতো।’ প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক এ এইচ এম মাহবুবুর রহমান দাবি করেন, অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনার জন্য কাজ চলছে। তিনি বলেন, ‘হলগুলোতে সিটকেন্দ্রিক সমস্যা আছে। আমরা সেগুলো নানাভাবে সমাধানের চেষ্টাও করছি।’

রাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবু এসব ঘটনার আংশিক সত্য বলে স্বীকার করেছেন। তার কথায়, ‘সকল অভিযোগ সত্য নয়। তবে প্রত্যেকটি অভিযোগ আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখেছি। খোঁজ নিয়ে দেখবেন, গত ৬ মাসে এমন একটিও ঘটনা নেই যে, আমরা সেটির জবাবদিহিতা নিশ্চিত করিনি কিংবা কোন ভুল বোঝাবুঝির যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ নিইনি। আমরা জবাবদিহিমূলক শিক্ষার্থীবান্ধব আদর্শিক ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আর আমরা সেই লক্ষ্যেই প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি।’

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব ঘটনা অবগত রয়েছে স্বীকার করেছেন প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক। তিনি বলেন, ‘বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট হল প্রশাসনকেও এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সবাই অপরাধ অস্বীকার করে আর প্রশাসন ন্যায়বিচারের আশ্বাস দেয়, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। কেন হয় না সেই প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের।


আরো পড়ুন