ইসলামের ইতিহাসে প্রথম উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ ছিল বদর। দ্বিতীয় হিজরির রমজান মাসে ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এটা ছিল মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। মহানবী (সা.) আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বাধীন একটি বাণিজ্য কাফেলাকে আটক করতে চেয়েছিলেন।
তিনি তা করতে চেয়েছিলেন হিজরতের পর মক্কার কুরাইশদের নানামুখী ষড়যন্ত্র, মদিনা থেকে মুসলমানদের বের করে দেওয়ার অন্যায় চাপ, মদিনার উপকণ্ঠে এসে লুটতরাজ ইত্যাদি কারণে। কিন্তু আবু সুফিয়ানের কাফেলা রাস্তা পরিবর্তন করে নিরাপদে মক্কায় পৌঁছে যায়। মক্কার মুশরিকরা এটাকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে মদিনায় সামরিক অভিযান চালায়। সহস্রাধিক সেনার কুরাইশি বাহিনীর বিরুদ্ধে ৩১৩ সদস্যের মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে।
কুরাইশের বহু শীর্ষ নেতা নিহত। মুসলিম বাহিনীর ১৪ জন শহীদ হন। বদর যুদ্ধের বিজয় মদিনায় সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করে। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ২/৭১)
বদর যুদ্ধের সুদূরপ্রসারী প্রভাব
বদর যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে মহিমান্বিত যুদ্ধ।স্বয়ং আল্লাহ এই যুদ্ধকে ‘ইয়াওমুল ফোরকান’ (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী) নাম দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে বদর যুদ্ধের বিজয় ইসলামের দাওয়াত, ইসলামের অগ্রযাত্রা ও মুসলিম উম্মাহকে প্রাথমিক স্তর থেকে পরিণত স্তরে উন্নীত করেছিল। এর ফলে ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক বাধাগুলো দূর হয়েছিল। বদর যুদ্ধের ফলাফল সংশ্লিষ্ট নানা শ্রেণিকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছিল। ঐতিহাসিকরা মনে করেন ‘ইয়াওমুল ফোরকান’ হিসেবে কিয়ামত পর্যন্ত ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের প্রভাব অব্যাহত থাকবে।
ঐতিহাসিকরা বদর যুদ্ধের নিম্নোক্ত প্রভাবগুলো তুলে ধরেন :
১. ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃত অভ্যুদয় : বদর যুদ্ধের পরই প্রকৃতপক্ষে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃত অভ্যুদয় ঘটেছিল। বদর যুদ্ধ সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর ঈমান, আল্লাহর ওপর আস্থা ও সাহসিকতা অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। কেননা তাঁরা বদর যুদ্ধে আল্লাহর প্রত্যক্ষ সাহায্য অবলোকন করেছিলেন। আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস তাঁদের কখনো পিছপা হতে দেয়নি, বরং পরিস্থিতি যতই অনুকূল হোক তাঁরা অসীম সাহসের সঙ্গে নিজেকে আল্লাহর রাস্তায় সঁপে দিয়েছেন।বদর যুদ্ধের পর আরব উপদ্বীপে ইসলামের পরিচিতি, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছড়িয়ে পড়ে। বদর যুদ্ধের আগে ইসলামকে তারা মক্কার অভ্যন্তরীণ সমস্যা মনে করত। কিন্তু মদিনায় হিজরত এবং বদর যুদ্ধে মক্কার কোরাইশদের শোচনীয় পরাজয় তাদেরকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। এ সময় তাদের অনেকের হৃদয় ইসলামের জন্য প্রশস্ত হয় এবং জ্ঞানীদের সামনে ইসলামী রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ স্পষ্ট হয়ে যায়।
২. মদিনার অভ্যন্তরে প্রভাব : জায়েদ বিন হারেসা (রা.)-কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পক্ষ থেকে মদিনায় পাঠানো হয়েছিল। তখন বদর যুদ্ধের ফলাফল মদিনায় আনন্দের ফল্গুধারা বইয়ে দিয়েছিল। ইসলাম ও মহানবী (সা.)-এর ব্যাপারে যারা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল তাদের অনেকে দ্বিধামুক্ত হয়। সবাই মহানবী (সা.)-এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। নবীজি (সা.) তিন দিন বদর প্রান্তে অবস্থানের পর ফিরে আসেন। বদর যুদ্ধে যাত্রার সময় অনেকেই ভাবেননি সামরিক সংঘাত হবে। তাই তাঁরা অংশগ্রহণের প্রয়োজন বোধ করেননি। কিন্তু যখন যুদ্ধ হলো এবং আল্লাহ ঐতিহাসিক বিজয় দিলেন, তখন তাঁরা মনে মনে লজ্জিত হলো এবং মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে নিজেদের অপারগতা প্রকাশ করতে লাগলেন। যেমন উসাইদ বিন হুদাইর (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর কসম, আমি ধারণা করিনি যে, আপনি শত্রু বাহিনীর মুখোমুখি হবেন। আমি ধারণা করেছি, আপনি বাণিজ্য কাফেলা আটক করবেন। যদি শত্রু বাহিনীর বিষয়টি ধারণা করতাম, তবে আমি পিছিয়ে থাকতাম না। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে সত্যায়ন করলেন। বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে না পারার আক্ষেপ তাঁদেরকে ওহুদ যুদ্ধে বিপুল উৎসাহের সঙ্গে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করেছিল। এ ছাড়া প্রাপ্ত গনিমত ও মুক্তিপণ মুসলমানদের আর্থিকভাবে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছিল।
৩. মক্কার মুশরিকদের ওপর প্রভাব : বদর যুদ্ধের ফলাফল ছিল কুরাইশদের জন্য বজ্রাঘাত ও মরণক্ষতের মতো, যা কুরাইশ নেতাদের মানসম্মান ও কথিত আভিজাত্যকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছিল। সমগ্র আরব উপদ্বীপে তাদের যে অপ্রতিরোধ্য প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল তার ক্ষয় শুরু হলো। কেননা এর আগে কোনো যুদ্ধে কুরাইশের এত যোদ্ধা নিহত বা বন্দি হয়নি। এমনকি হাইসামান বিন আবদুল্লাহ খুজায়ি প্রথম পরাজয়ের সংবাদ নিয়ে গেলে তারা তা অবিশ্বাস করল এবং দ্বিতীয় সংবাদবাহকের অপেক্ষা করতে লাগল। অতঃপর যখন আবু সুফিয়ান ইবনে হারিস ইবনে আবদুল মুত্তালিব এসে একই সংবাদ দিল, তখন তারা বিশ্বাস করল। বদর যুদ্ধের পরাজয়ের এক সপ্তাহ পর দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আবু লাহাব মারা যায়। মক্কার এমন কোনো ঘর ছিল না যার ঘরে শোক পৌঁছেনি। এই পরাজয়ের ফলে মক্কাবাসীর জন্য শাম ও ইয়েমেনে বাণিজ্য করা কঠিন হয়ে যায়। কেননা তারা মদিনার উপকণ্ঠ দিয়ে শাম ও ইয়েমেনে যাতায়াত করত। (শারজানি, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা, পৃষ্ঠা ৫২৪-৫২৯)
৪. মরণ কামড়ের চেষ্টা : বদর যুদ্ধের পর সবচেয়ে গুরুতর ঘটনা ছিল মহানবী (সা.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র। উমায়ের ইবনে ওয়াহাব জুমহি নামের এক নরাধম এই ষড়যন্ত্রের হোতা ছিল। সে মক্কায় মহানবী (সা.)-কে নানাভাবে কষ্ট দিত। বদর যুদ্ধে তার ছেলে ওয়াহাব ইবনে উমায়ের মুসলমানের হাতে বন্দি হয়। একদিন কাবার হাতিমে বসে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়ার সঙ্গে কথা বলছিল। তারা বদরের যুদ্ধে নিহতদের নিয়ে কথা বলছিল। তখন উমায়ের ইবনে ওয়াহাব আক্ষেপ করে বলল, আমি যদি ঋণগ্রস্ত না হতাম এবং পরিবারের জন্য চিন্তা না থাকত, তবে মদিনায় গিয়ে মুহাম্মদকে শেষ করে দিতাম। তখন সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া বলল, আমি তোমার ঋণ ও পরিবারের দায়িত্ব নিলাম।চুক্তি অনুসারে উমায়ের তার তরবারিতে বিষ মিশিয়ে মদিনায় গেল। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) কয়েকজন আনসার সাহাবির সাহায্যে তাকে নবীজি (সা.)-এর সামনে উপস্থিত করলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তার কাছে মদিনায় আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। উমায়ের প্রথমে ছেলেকে মুক্ত করতে এসেছে দাবি করল। কিন্তু যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের ষড়যন্ত্রের কথা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন, তখন সে কালেমা পাঠ করে মুসলমান হয়ে গেল। সে ইসলাম গ্রহণের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) তার ছেলেকেও মুক্ত করে দেন এবং তাকে কোরআন শেখানোর ব্যবস্থা করেন। মক্কায় ফিরে গিয়ে সে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করল এবং বহু মানুষ তার মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণ করে। (আর রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ২৪০)
বদর যুদ্ধের প্রভাব সম্পর্কে আল্লামা শিবলি নোমানি (রহ.) চমৎকার লিখেছেন, ‘বদর যুদ্ধের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রভাব ছিল প্রবল ও সুদূরপ্রসারী। প্রকৃতপক্ষে এটাই ছিল ইসলামের প্রথম অগ্রযাত্রা। এই যুদ্ধে কুরাইশ গোত্রের নেতৃত্বের স্তম্ভগুলো ভেঙে পড়েছিল। যে দুর্বলতা তারা আর কখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।’ (মুখতাসার সিরাতুন্নবী, পৃষ্ঠা ৯২)
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন